২০২০ সালে আনুমানিক ২.৪ বিলিয়ন মানুষ প্রাথমিকভাবে কাঠ, কাঠকয়লা বা কয়লা-নির্ভর দূষণ-সৃষ্টিকারী রন্ধন–চুলার উপর নির্ভরশীল ছিল, যেখানে বিশ্বব্যাপী ৬৯ শতাংশের পরিচ্ছন্ন রন্ধন–চুলা ছিল। অ্যাজেন্ডা ২১–এর স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্য ৭ (এসডিজি৭)–এর অধীনে ২০৩০ সালের মধ্যে অ–দূষণকারী রন্ধন সমাধানগুলিতে সর্বজনীন প্রবেশাধিকার হল একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য। জি২০ বালি নেতাদের ঘোষণাটিতে ‘এসডিজি৭ লক্ষ্য অর্জনের এবং শক্তির প্রবেশাধিকার ও শক্তির দারিদ্র্য দূরীকরণের ফাঁকফোকর বন্ধ করার প্রচেষ্টার প্রতিশ্রুতি’ পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
রন্ধনক্ষেত্রে শক্তি–দারিদ্র্যের গভীর প্রভাব রয়েছে জনস্বাস্থ্যগত, পরিবেশগত ও লিঙ্গভিত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে। এর ফলে বছরে ৩.২ মিলিয়ন এমন অকালমৃত্যু ঘটে যা প্রতিরোধ করা যেত। রান্নার জন্য ব্যবহৃত জ্বালানি কাঠের প্রায় ৩০ শতাংশ এমন অপরিকল্পিতভাবে কাটা হয় যা বনের অবক্ষয় ঘটায় এবং প্রতি বছর দূষণ নির্গমণ করে ১ গিগাটন কার্বন ডাইঅক্সাইডের সমতুল্য । এই পরিমাণটি বিশ্বব্যাপী সিওটু নির্গমনের প্রায় ২ শতাংশ। বৈশ্বিক দক্ষিণের মহিলা ও শিশুরা রান্নার জন্য জ্বালানি সংগ্রহ করতে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যয় করেন। সাব–সাহারান আফ্রিকার মতো চূড়ান্ত শক্তি-দারিদ্র্যের এলাকায় রন্ধনক্ষেত্রের পরিস্থিতি বিশেষভাবে ভয়াবহ, এবং সেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখনও প্রাপ্তিযোগ্যতার হারের উন্নতির চেয়ে বেশি।
পরিচ্ছন্ন রন্ধন পরিসর সৃষ্টির ক্ষেত্রে অগ্রগতি এবং অনুমানগুলি একটি মিশ্র ছবি তুলে ধরে। ২০১০ থেকে ২০২০–র মধ্যে আনুমানিক ০.৬ বিলিয়ন মানুষ বিশ্বব্যাপী পরিচ্ছন্ন রন্ধনের উপায় পেয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) অনুমান করে যে ডব্লিউএইচও প্রাপ্তিযোগ্যতার ব্যবস্থা ত্বরান্বিত না করলে ২০৩০ সালেও বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় এক–চতুর্থাংশের পরিচ্ছন্ন রান্নার সুযোগের প্রাপ্তিযোগ্যতার অভাব থাকবে। এছাড়াও, যদি অতিমারি থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ধীরে ধীরে হয়, তাহলে ২০৩০ সালে আরও প্রায় ৪৭০ মিলিয়ন মানুষ পরিচ্ছন্ন রান্নার সুযোগ পেতে সক্ষম হবেন না, যা অনুমিত জনসংখ্যার অতিরিক্ত আরও ৫.৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক বর্ধিত ভূ–রাজনৈতিক উত্তেজনার ফলস্বরূপ অস্থির বৈশ্বিক জ্বালানি–বাজারগুলিতে তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি পরিচ্ছন্ন রান্নার সুযোগকে আরও অনেক দরিদ্র পরিবারের নাগালের বাইরে ঠেলে দিচ্ছে।
একটি সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাঙ্ক এসম্যাপ/এমইসিএস সমীক্ষায় সর্বজনীন পরিচ্ছন্ন রান্নার সুযোগের অভাবের অর্থনৈতিক ব্যয় অনুমান করা হয়েছে ২.৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিপরীতে, ২০৩০ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রতি বছর মাত্র ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (সরকারি ক্ষেত্রে ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ) বিনিয়োগ প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের সঙ্গে এই নিষ্ক্রিয়তার মূল্যের তুলনা করলে দেখা যায় বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের থেকে অসাধারণ ফেরতলাভ পাওয়া যেতে পারে; তবুও কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ব্যতীত বেসরকারি বিনিয়োগকারী বা সরকারের তরফ থেকে পরিচ্ছন্ন রান্নার সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখা যায়নি।। ২০১৮ সালে এই খাতে মাত্র ১৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের রিপোর্ট থেকেই এই বিষয়টি স্পষ্ট।
বৈশ্বিক রন্ধন ক্ষেত্রে বৃহৎ আকারের রূপান্তরের এই অ্যাজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি মূল বাধা হল এই রূপান্তরের চালকদের সম্পর্কে তথ্য ও জ্ঞানের বিশাল ঘাটতি। এই ধরনের জ্ঞান বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে পারে, যা এই ক্ষেত্রটির জরুরি প্রয়োজন। পরিকাঠামোর অভাব এবং দারিদ্র্য, পিতৃতন্ত্র ও সচেতনতার নিম্নস্তরের শিকার জনসম্প্রদায়গুলির ক্ষেত্রে ব্যবসার মডেল ও অর্থ–সহ পরিচ্ছন্ন রন্ধনের প্রাপ্তিযোগ্যতাই এখনও একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়ে গেছে। প্রাথমিক গ্রহণ ও ব্যবহার, এবং পরবর্তীতে পরিচ্ছন্ন রন্ধন ব্যবস্থার টেকসই ব্যবহার, এই দুটিকেই নজরে রাখা এবং বোঝা দরকার। এটি শুধু বিনিয়োগ ও নীতির নকশার ক্ষেত্রেই সাহায্য করবে না, বরং অন্যত্র এই সাফল্যের প্রতিলিপি করতেও সাহায্য করতে পারে। এর জন্য নতুন অভিজ্ঞতামূলক বিশ্লেষণের প্রয়োজন, যার মধ্যে আছে অনুদৈর্ঘ্য অধ্যয়ন যা পরিচ্ছন্ন রন্ধন ব্যবস্থার টেকসই ব্যবহার বজায় থাকছে কি না, এবং যদি না–থাকে তবে এর প্রতিবন্ধকতাগুলি কী, তা অধ্যয়ন করে। কার্যকর পরিচ্ছন্ন রন্ধন কর্মসূচি তৈরি করার জন্য মানবকল্যাণে এই জাতীয় কর্মসূচির প্রভাবের মূল্যায়ন প্রয়োজন। সেইসঙ্গেই উন্নত ডেটা সংগ্রহ এবং নির্দিষ্ট প্রকল্পগুলির বিশ্লেষণের পাশাপাশি প্রয়োজন তুলনামূলক বিশ্লেষণ, যা প্রকল্প ও প্রসঙ্গ–জুড়ে পারস্পরিক অনুধাবনের (ক্রস–লার্নিং) সুযোগ দেয়।
ক্রস–কনটেক্সট লার্নিং হল ব্যাপক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যসম্পন্ন বৈশ্বিক দক্ষিণজুড়ে জ্ঞান ভাগ করে নেওয়ার একটি বিশেষভাবে উপযোগী, সাশ্রয়ী ও বাস্তবসম্মত উপায়। এই ধরনের ক্রস–লার্নিং অবশ্যই শিল্পের কুশীলব ও নীতিনির্ধারকদের কাছে জ্ঞানকে সহজলভ্য করতে সক্ষমতা–নির্মাণ কর্মশালা ও সময়োপযোগী নীতির রূপ নিতে পারে। এর জন্য বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানির অভিজ্ঞতাগুলিকে পদ্ধতিগতভাবে ধরা এবং তার একটি সেট তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে নতুন কুশীলব ও নতুন কর্মসূচিগুলির জন্য সর্বোত্তম অনুশীলন সহজ হয় ৷ উদাহরণস্বরূপ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা (পিএমইউওয়াই)–র সফল রূপায়ণ ৯০ মিলিয়ন দরিদ্র মহিলাকে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) পেতে সক্ষম করেছে। এটি আয়তন ও গতিতে অভূতপূর্ব ছিল, এবং এই জাতীয় প্রক্রিয়ায় কী করা উচিত (এবং কী করা উচিত নয়) সে সম্পর্কে স্পষ্টভাবে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ দিয়েছে। অন্য একটি উদাহরণ হল কোকো, আফ্রিকায় চালু একটি বেসরকারি সংস্থা, যারা দূষণকারী কিন্তু সর্বব্যাপী কাঠকয়লা বিক্রির বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে জ্বালানি এটিএমের একটি বড় নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে তরল বায়োইথানল বিক্রি করে। এই ধরনের ঘটনা থেকে পাঠ ভাগ করে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন বৈশ্বিক দক্ষিণ জুড়ে গবেষক, বেসরকারি ও সরকারি ক্ষেত্রের অংশীদারদের ঘনিষ্ঠ ও ক্রমাগত যোগাযোগ।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী মোদী ঘোষিত গ্লোবাল সাউথ সেন্টার অফ এক্সিলেন্স এই ক্ষেত্রের শূন্যতা পূরণ করতে পারে। ভারতের ‘বৈশ্বিক দক্ষিণের কণ্ঠস্বর’ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে, এবং পরিচ্ছন্ন রন্ধনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে জ্ঞান উৎপাদন ও প্রচারের একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি তৈরি করে সে এই প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিতে পারে। ভারতের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা যথেষ্ট, এবং তা দিয়ে কোন অনুশীলনগুলি ভালভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে গভীরভাবে বিবেচনার প্রক্রিয়া ভারত শুরু করতে পারে। সেইসঙ্গেই ভারত পিএমইউওয়াই–এর অভিজ্ঞতা, এবং ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি নতুন সৌর–বৈদ্যুতিক রান্নার স্টোভ চালু করার পর আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ৩০ মিলিয়ন পরিবারের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনার অভিজ্ঞতা, শেয়ার করতে পারে। বৈশ্বিক দক্ষিণ–জুড়ে তার ‘শুভেচ্ছা’ ব্যবহার করে ভারত সেই দেশগুলির একটি জোটের নেতৃত্ব দিতে পারে যেগুলিকে গ্লোবাল সাউথ সেন্টার অফ এক্সিলেন্সের মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন রন্ধনের সুযোগ বাড়ানোর প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করতে হবে৷ এটি একটি গেমচেঞ্জার হতে পারে, যা এই ক্ষেত্রে কঠোরভাবে রান্নার শক্তির দারিদ্র্যের ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের সমাধান করার জন্য বিরাটভাবে প্রয়োজন।