জি২০-র সভাপতি হিসাবে ভারত উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যকার ব্যবধান মোকাবিলা করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মতো বিশ্বব্যাপী সংস্থাগুলিকে উন্নত করার একটি উল্লেখযোগ্য সুযোগের সম্মুখীন হয়েছে। এটির ২১ শতকের ভারতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলির অন্যতম হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি অর্জনের জন্য দেশগুলির মধ্যে মূল বিতর্কিত বিষয়গুলিকে বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি ক্রমবর্ধমান আন্তঃসংযুক্ত এবং আন্তঃনির্ভর বিশ্বে বহুপাক্ষিকতা বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত বিষয়ে সংলাপ, আলোচনা এবং যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো হিসাবে কাজ করে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে ভারসাম্যহীনতা এবং ঘাটতি পূরণ করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে বাজারে প্রবেশাধিকার, শুল্ক এবং ভর্তুকি, বিশেষ সুযোগ, আলোচনার ক্ষমতা, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত সমস্যাগুলি। আরও ন্যায়সঙ্গত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এই প্রতিবন্ধকতাগুলি মোকাবিলা করা অত্যন্ত জরুরি।
ভারত এবং ডব্লিউটিও-র মধ্যে বেশ কয়েকটি বিরোধ রয়েছে, যা সমাধান করা দরকার:
ক) কৃষি চুক্তিতে একটি ‘শান্তি ধারা’ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যা দেশগুলিকে ডব্লিউটিও-র বিরুদ্ধাচরণ না করে খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য ভর্তুকি সীমা অতিক্রম করার সুযোগ দেয়। ধানচাষিদের জন্য ভর্তুকি সীমা লঙ্ঘন করার পরে বাজারের বিকৃতি এবং অন্যায্য সুবিধার বিষয়ে অন্যান্য দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করার পরে ভারত এই ধারাটি চালু করেছে।
খ) ট্রিপস চুক্তির অধীনে, উন্নয়নশীল দেশগুলি সাশ্রয়ী মূল্যের ওষুধের সীমিত লভ্যতা, প্রযুক্তি স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তা, ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষা, প্রয়োগ সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা, নমনীয়তা ও বিশেষ সুযোগ এবং জনস্বার্থের সঙ্গে মেধা সম্পত্তি অধিকারের ভারসাম্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। তারা এই সমস্যাগুলি মোকাবিলা করতে এবং ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত ফলাফল নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থার দাবি জানায়। উন্নয়নশীল দেশগুলি ট্রিপস-এর মধ্যে নমনীয়তা এবং বিশেষ প্রবিধানগুলি বজায় রাখার তাত্পর্যের উপর জোর দেয়। এই প্রবিধানগুলি তাদের অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাগুলিকে বিবেচনা করে নির্দিষ্ট উন্নয়নমূলক প্রয়োজন অনুসারে তাদের বৌদ্ধিক সম্পত্তি ব্যবস্থাকে নিজেদের ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে সক্ষম করে। উন্নয়নশীল দেশগুলিও বৌদ্ধিক সম্পত্তির অধিকার রক্ষা ও জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবার লভ্যতার প্রচারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তাকে ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরে। তারা বৌদ্ধিক সম্পত্তি অধিকারের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিকগুলির স্বীকৃতির জন্য যুক্তি দর্শায়।
ডিজিটাল যুগে আন্তঃসীমান্ত তথ্য প্রবাহ ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যার ফলে সীমানা জুড়ে তথ্যের আদান-প্রদান এবং সঞ্চয় করা সম্ভব। অবশ্য এর সঙ্গে সংযুক্ত বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান, যেমন ইন্টারনেট সংযোগ ও প্রযুক্তির অসম লভ্যতা দেশগুলির মধ্যে একটি ডিজিটাল বিভাজন তৈরি করে। এই বিভাজন আন্তঃসীমান্ত তথ্য প্রবাহে উন্নয়নশীল দেশগুলির অংশগ্রহণকে বাধা দান করতে পারে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যকে বৃদ্ধি করতে পারে। এই প্রতিবন্ধকতাগুলি মোকাবিলা করার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, অভিন্ন সাধারণ গুণমান এবং কাঠামোর বিকাশ এবং আন্তঃসীমান্ত তথ্য প্রবাহে বিশ্বাস ও স্বচ্ছতার প্রচার প্রয়োজন।
সমস্ত ক্ষেত্রে ডিজিটালকরণের ফলে অর্থনীতির আসল কথা হয়ে উঠেছে তথ্য এবং সীমানা ছাড়িয়ে তার প্রবাহ। ডিজিটাল অর্থনীতিতে তথ্যের লভ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সকলের জন্য এর লভ্যতা আইনি ও প্রযুক্তিগত পরিসরে উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির সৃষ্টি করে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআই-এর অন্তর্ভুক্তি আরও একগুচ্ছ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে, যার জন্য বিবিধ বিষয় সম্পর্কিত একটি গাইডিং ফ্রেমওয়ার্ক বা নির্দেশক কাঠামোর খসড়া তৈরি এবং তা প্রয়োগ করা দরকার।
আইনি মামলা এবং সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আইনি কাঠামো বিবর্তিত হলেও এই পরিসরে আরও অনেক কিছুই করার রয়েছে। একটি সুই জেনেরিস ফ্রেমওয়ার্ক এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা নিরবচ্ছিন্ন আন্তঃসীমান্ত তথ্য প্রবাহের জন্য ব্যক্তিগত এবং অব্যক্তিগত তথ্যের লভ্যতা, সংগ্রহ, ব্যবহার, নগদীকরণ ইত্যাদি বিষয়ে মৌলিক নিয়ম ও প্রবিধানগুলিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলার নির্দেশিকা প্রদান করবে।
বিভিন্ন সর্বাত্মক তথ্য সুরক্ষা কাঠামো নানাবিধ এক্তিয়ার দ্বারা বাস্তবায়িত এবং প্রস্তাবিত হয়েছে। ব্যক্তিগত তথ্য, তথ্য হিসাবে যা কোনও ব্যক্তিকে সনাক্ত করে বা ডেটা সুরক্ষা নিয়মের মাধ্যমে এক জন ব্যক্তিকে শনাক্তযোগ্য করে তোলে, যেমন, ইইউ-এর জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন অথবা ভারতের ডিজিটাল পার্সোনাল ডেটা প্রোটেকশন বিল, ২০২২-এর খসড়া। তথ্য নগদীকরণকে বলবৎযোগ্য আইনি অধিকারের একটি দিক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বর্তমানে অপূর্ণ এবং অনিয়ন্ত্রিত। এর জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো তৈরি করতে অংশীদারদের সঙ্গে আরও আলোচনা দরকার। একই সঙ্গে নগদীকরণের বিষয়টি মেধা সম্পত্তি বা অন্য ধরনের অধিকারের আওতায় পড়বে কি না, সে নিয়েও আলোচনার অবকাশ রয়েছে।
এটি এখন ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে, তথ্য ভাগ করে নেওয়া সাধারণ ভাবে সমাজের সেবায় এবং অভিন্ন সাধারণ স্বার্থের অসংখ্য উদ্দেশ্যের আলোকে উদ্ভাবনকে উত্সাহ জোগাবে। আইনি কাঠামো যেগুলি স্বেচ্ছায় তথ্য ভাগ করে নেওয়ার বিষয়টিকে উত্সাহ জোগায়, সেগুলিকে সমর্থন করা উচিত, বিশেষ করে যেগুলি লাইসেন্সিং-এর সঙ্গে সম্পর্কিত। আইনপ্রণেতারা নতুন তথ্যের লভ্যতা এবং অধিকার আইন ব্যবহার করতে শুরু করেছেন, যেখানে তথ্যের মালিকরা বাজারগুলি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তথ্য প্রকাশ করতে অনিচ্ছা প্রদর্শন করছেন, বিশেষ করে আফটারমার্কেট। এমনটা করার নেপথ্যে প্রধান উদ্দেশ্য হল তথ্যের বিস্তৃত লভ্যতা।
চিরাচরিত ভাবে সীমানা পেরিয়ে পরিষেবা পেশাদারদের চলাচল পৃথক দেশের অভিবাসন নীতি এবং দেশগুলির মধ্যে চুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ডব্লিউটিও- র জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড ইন সার্ভিসেস (জিএটিএস) বিভিন্ন দেশে পরিষেবা প্রদানকারীদের সাময়িক চলাচল-সহ পরিষেবাগুলিতে বাণিজ্যের উদারীকরণের জন্য একটি কাঠামো প্রদান করে। জিএটিএস সদস্য দেশগুলিকে পরিষেবাগুলিতে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের উপর বিধিনিষেধ সহজতর করার জন্যও উত্সাহ জোগায়, যার মধ্যে পরিষেবা পেশাদারদের অস্থায়ী চলাচল, যেমন ব্যবসায়িক ব্যক্তি, পরামর্শদাতা এবং অন্যান্য দক্ষ কর্মীদের চলাচল রয়েছে। এই মুহূর্তে বিভিন্ন দেশের জন্য অভিবাসন নীতি নির্ধারণের কর্তৃত্ব ডব্লিউটিও-র নেই। এটি প্রাথমিক ভাবে মুক্ত বাণিজ্যের প্রচার এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাধা কমানোর সঙ্গে সম্পর্কিত। এমনটা বলা হলেও সীমানা পেরিয়ে সহায়তা প্রদানকারী পেশাদারদের চলাচল-সহ পরিষেবা বাণিজ্যের গুরুত্বকে ডব্লিউটিও স্বীকৃতি দিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড ইন সার্ভিসেস (জিএটিএস) – যা একটি ডব্লিউটিও চুক্তি – বিশেষ ভাবে পরিষেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে সাধারণ ব্যক্তিদের চলাচলের বিষয়টিকে তুলে ধরে।
পেশাদারদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অস্থায়ী প্রবেশের সুবিধার্থে ডব্লিউটিও-র সদস্য দেশগুলির সঙ্গে কাজ করা উচিত। এর পাশাপাশিই জিএটিএস চুক্তিকে সংশোধন করতে হবে, যাতে এটি শুধুমাত্র একটি কাঠামো নয়, সমস্ত সদস্য দেশের জন্য একটি বাধ্যতামূলক আইনে পরিণত হয়৷ চুক্তিতে পেশাদারদের অভিবাসী হিসাবে নয়, বরং পরিষেবা প্রদানকারী হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। পরিষেবার জন্য জনশক্তিকে উদার শাসনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এটি বিশ্ব অর্থনীতিকে এক ব্যাপক গতিতে বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করবে।
জি২০ উন্নত এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের মিশ্রণ এবং একই সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ হিসেবে ডব্লিউটিও সংস্কারের অগ্রগতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এখানে কিছু সম্ভাব্য পদক্ষেপ রয়েছে, যা জি২০ গ্রহণ করতে পারে:
১) বহুপাক্ষিকতাকে সমর্থন করা: জি২০ বহুপাক্ষিকতা এবং নিয়মভিত্তিক বাণিজ্য ব্যবস্থার প্রতি তার প্রতিশ্রুতিকে পুনর্নিশ্চিত করতে পারে। এটি একটি শীর্ষ সম্মেলনে জি২০ নেতাদের একটি যৌথ বিবৃতি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে, যেখানে ডব্লিউটিও-র গুরুত্ব এবং সেটিকে শক্তিশালী করার জন্য সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়া হবে।
২) ডব্লিউটিও সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেওয়া: জি২০ তার সম্মেলনে একটি মূল কর্মসূচি হিসাবে ডব্লিউটিও সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিতে পারে। এর মধ্যে সংস্কারের জন্য নির্দিষ্ট ক্ষেত্র চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ বা টাস্ক ফোর্স গঠন করা এবং পদক্ষেপের জন্য প্রস্তাবনা তৈরির কাজও অন্তর্ভুক্ত।
৩) বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতার মোকাবিলা: জি২০ বিশ্ব বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা মোকাবিলায় কাজ করতে পারে, যা সাধারণত বাণিজ্য সংক্রান্ত উত্তেজনা বৃদ্ধি করে এবং ডব্লিউটিও-র কার্যকারিতাকে দুর্বল করে। এর মধ্যে বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা হ্রাস এবং বাণিজ্য উদারীকরণ প্রচারের উদ্যোগ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
৪) স্থিতিশীল উন্নয়নের প্রচার: জি২০ বাণিজ্যের মাধ্যমে স্থিতিশীল উন্নয়নের প্রচার করতে পারে, যা সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলায় সাহায্যে সক্ষম। এর মধ্যে ন্যায্য বাণিজ্য এবং স্থিতিশীল উত্পাদন অনুশীলন প্রচারের উদ্যোগ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
সামগ্রিক ভাবে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদান এবং সদস্য দেশগুলির সঙ্গে সহযোগিতার প্রচারের মাধ্যমে ভারত ডব্লিউটিও সংস্কারের অগ্রগতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে জি২০ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং উন্নয়নের প্রচারের জন্য ডব্লিউটিও-কে প্রধান প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার কাজে সাহায্য করতে পারে।