ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ইতিহাসের একটি অতি–গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ভারত সবচেয়ে শক্তিশালী বহুপাক্ষিক গোষ্ঠীর নেতৃত্বে থাকবে বললে কমই বলা হবে। সুনিশ্চয়তা এখন অতীতের শব্দ। মতাদর্শ, ভূগোল ও জনবিন্যাস এখন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, জলবায়ু সক্রিয়তা ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার উপর প্রভাব ফেলে এবং প্রভাবিত হয়। সব কিছুকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করাই এখন প্রথা, কারণ সংলাপের জায়গা নিয়েছে বিরোধ। ভারতের সভাপতিত্বের সময় এটাই ভূদৃশ্য, এবং সেখানেই ভারত হতে পারে ঝড়ের বাতিঘর।
ভারত এমন একটি সভ্যতা যা বৈচিত্র্য উদযাপন করে, যা একাধিক ইতিহাস দ্বারা আকৃতি পেয়েছে এবং সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ক্যালিডোস্কোপ দ্বারা সহস্রাব্দের পর সহসাব্দ ধরে গড়ে উঠেছে। বিগত ৭৫ বছরে ভারত বিভেদের মধ্যেও ঐকমত্য গড়ার, এবং এমনকি উন্নতি করার, এক অসাধারণ ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’: এই প্রবাদটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিতে গোলযোগ নির্বিশেষে ভারতের জন্য একটি সত্য। এটি এমন একটি উদাহরণ যা বিশ্বের আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। যদি বহুপাক্ষিকতা সফল করতে হয় তবে জি২০ দেশগুলিকে তার জন্য আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, এবং নিজেদের মধ্যে ও অন্যদের সঙ্গে সংলাপ জোরদার করতে হবে। এতে সহায়তা করবে ‘ভারতের পথ’। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তো নভেম্বরে তাঁর মাসিক রেডিয়ো সম্প্রচারেই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন: “ভারতকে অবশ্যই বিশ্বব্যাপী মঙ্গল ও কল্যাণের দিকে মনোনিবেশ করে জি২০ নেতৃত্বের সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।’’
থিঙ্ক২০ হল থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও পণ্ডিতদের একটি গোষ্ঠী, যাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে জি২০–র ‘আইডিয়াজ হাব’। এটি একটি অফিসিয়াল এনগেজমেন্ট গ্রুপ, যা শেরপা ট্র্যাককে সমর্থন করে এবং জি২০ নেতাদের বিবেচনার জন্য ইনপুট প্রদান করে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্থনের এই মুহূর্তে দুর্দশাগ্রস্ত জনসম্প্রদায় বা দেশগুলিকে সহায়তা করার জন্য একটি অভিন্ন জি২০ মূল্যায়ন এবং প্রতিক্রিয়া কাঠামো সংজ্ঞায়িত করা অপরিহার্য। যথাযথভাবেই বিশেষভাবে গঠিত থিঙ্ক২০ টাস্ক ফোর্স বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতি এবং বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলের মধ্যে সম্পর্ক, এবং তা কীভাবে জাতীয় সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিগুলি দিয়ে প্রভাবিত হয় তা পরীক্ষা করবে। টাস্ক ফোর্সটি দেশগুলির অভ্যন্তরে এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে মুদ্রা নীতি ও আর্থিক নীতির আরও ভাল সমন্বয়ের প্রয়োজনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে। কিছু দেশ যে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার নেতিবাচক প্রভাব থেকে সরবরাহ শৃঙ্খল ও বাণিজ্যকে কীভাবে রক্ষা করা যায় সে সম্পর্কেও এটি ধারণা দেবে। মূল অর্থে, এটি চাকরি ও জীবিকার রক্ষা ও প্রসারের জন্য মতামত ও প্রস্তাব দেবে।
এই আলোচনাগুলি হচ্ছে হাইপার ডিজিটালাইজেশন এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পটভূমিতে। একটি থিঙ্ক২০ টাস্ক ফোর্স শুধু ডিজিটাল সরকারি পরিকাঠামো এবং এর গুরুত্বের উপর আলোকপাত করবে। এটি বিভিন্ন ক্ষেত্রব্যাপী দায়বদ্ধ, সাশ্রয়ী, ও ন্যায়সঙ্গত ডিজিটাল বিবর্তনের পরীক্ষা করবে, এবং ডিজিটাল সরবরাহ শৃঙ্খলগুলিকে আরও স্থিতিস্থাপক ও বিকেন্দ্রীকৃত করার উপায় খুঁজে বের করবে। বিভিন্ন জি২০ দেশের বিশেষজ্ঞদের এই গোষ্ঠীটির উদ্দেশ্য হল অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোক্তা, চাকরি ও জীবিকার প্রসারের উপায়, এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও ডিজিটাল পরিধিতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা করা।
এই ধরনের যে কোনও প্রয়াসের মধ্যে অবশ্যই গ্রহগত বিবেচনা থাকতে হবে, এবং বৃহত্তর সবুজ পরিবর্তনের অংশ হতে হবে। এটি রূপান্তর অর্থায়ন বা ট্রানজিশন ফাইনান্সিংকে আরও জরুরি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলতে, এবং মূল প্রযুক্তির বিস্তার ও নতুন শক্তি সমাধানগুলির ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করবে। একটি সংশ্লিষ্ট টাস্ক ফোর্স বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাঙ্কগুলির ভূমিকা এবং সংস্কার, উদ্ভাবনী আর্থিক উপকরণ ও সরঞ্জামগুলির আকার, এবং সেই সঙ্গে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বৈশ্বিক ব্যক্তিগত পুঁজির সম্পূর্ণ সম্ভাবনা উন্মোচন করার উপায়গুলির মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করবে। এটি এই প্রচেষ্টাগুলিতে সহায়তা করার প্রশ্নে জি২০–র জন্য একটি কার্যকরী ফলাফল তুলে ধরবে।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, এবং প্রকৃত সবুজ রূপান্তর ও ডিজিটালাইজেশনের মতো সব কিছুর একটি মূল লক্ষ্য থাকতে হবে: সমস্ত মানুষ ও প্রাণসত্তা এবং পৃথিবীগ্রহের সেবা। এখন যখন প্রেসিডেন্সি ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারত হয়ে তারপরে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যাবে, সেই সময় অ্যাজেন্ডা ২০৩০ ও স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি–গুলি) অর্জনের অন্বেষণকে জি২০–র অংশ হতে হবে। জি২০ ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট ভাল কাজ করেছে; এর চ্যালেঞ্জ এখন ‘মানুষ ও এই গ্রহের’ সেবা করা।
থিঙ্ক২০–র একটি টাস্ক ফোর্স শুধুই এই দিকের উপর ফোকাস করবে। এসডিজি–গুলি অতিমারি ও বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে সংঘাতের কারণে ধাক্কা খেয়েছে। পরিবর্তিত জলবায়ু ও অনিয়মিত আবহাওয়ার ধরন একটি অতিরিক্ত বোঝা যোগ করেছে। আমরা সকলেই সমাজগত স্থিতিস্থাপকতার গুরুত্ব সম্পর্কে তীব্রভাবে সচেতন; এবং এসডিজি–গুলির বাস্তবায়নের জন্য বিজ্ঞান, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির ব্যবহার হল প্রয়োজনীয় মাধ্যম। এগুলি জি২০ এবং থিঙ্ক২০ কাজের মূল ভিত্তি তৈরি করবে, এবং তার পাশাপাশি থাকবে জল সুরক্ষার উপর জোর দেওয়া, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিতে সামগ্রিক ফলাফলের প্রয়াস, লিঙ্গ–নেতৃত্বাধীন উন্নয়ন মডেল ও বৃদ্ধি, এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা।
এই সমস্ত বিষয় দেখবে একটি প্রতিভা–সমন্বয়, যা জি২০ দেশগুলি থেকে বৃহত্তর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। অতীতের আলোচনায় এই ধরনের অংশগ্রহণ কম ছিল। উদীয়মান ভৌগোলিক অঞ্চলের কণ্ঠস্বর মঞ্চের কেন্দ্রে থাকবে। বিভিন্ন বিষয় ও ক্ষেত্রজুড়ে টাস্ক ফোর্সের ১০০ জনেরও বেশি বিশেষজ্ঞ থাকবেন, এবং সারা দেশের প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠান থেকে একটি প্রাণবন্ত সর্বভারতীয় অংশগ্রহণও দেখা যাবে। একটি বিশ্বব্যাপী উপদেষ্টা কমিটিও গঠন করা হবে। এতে থাকবেন অতীতের প্রেসিডেন্সির থিঙ্ক২০ চেয়ার এবং আসন্ন প্রেসিডেন্সির বিশিষ্ট থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বিশেষজ্ঞরা। প্রবীণদের এই দলটি ভারতের নেতৃত্বাধীন প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভাগ করে নেবেন। শেষ পর্যন্ত, ভারতের প্রেসিডেন্সি থাকাকালীন বৌদ্ধিক সমষ্টি গুণগত এবং পরিমাণগতভাবে আগের যে কোনও বছরের থেকে আলাদা হবে। ভাগ্য ও প্রচেষ্টা সহায় হলে ভারত জি২০ অভিধান পরিবর্তন করে ২০২০–র দশকের জন্য প্রস্তুত করবে।
*ডঃ সমীর সারন, প্রেসিডেন্ট, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন এবং থিঙ্ক২০ সেক্রেটারিয়েট–এর চেয়ার