সাব–সাহারান আফ্রিকা ২০১৯ সাল থেকে চলা বিধ্বংসী অতিমারির ফলে উদ্ভূত এক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে, এবং এটি পশ্চিম আফ্রিকার জটিল আপৎকালীন পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জগুলির প্রকৃষ্টতম উদাহরণ।
এই অঞ্চলের ভূ–রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তনশীল গতিশীলতা, গিনি উপসাগরে অরক্ষিত অবস্থা, সাহেল সাহারা বিভাজন, জলবায়ু পরিবর্তন, ও অন্যান্য পরিবেশগত অবনতি আফ্রিকা মহাদেশের সমৃদ্ধ ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল তথা বৃহত্তরভাবে বিশ্বের শান্তির প্রতিবন্ধক।
নাইজেরিয়া, মালি, বুরকিনা ফাসো, ক্যামেরুন, ইথিওপিয়া ইত্যাদি দেশগুলি দুর্বল রাজনৈতিক ও রাজস্ব–শাসন ক্ষমতার কারণে ভেঙে পড়ছে বলে মনে করা হয়। এই কারণগুলি বছরের পর বছর ধরে পশ্চিম আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলিতে দুর্নীতি, অনিশ্চয়তা ও তীব্র নিরাপত্তাহীনতাকে লালন করেছে। প্রাকৃতিক, মানবিক ও বস্তুগত সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও এই অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র অঞ্চল। ইন্টারন্যাশনাল পিস ইনস্টিটিউট তার ওয়েস্ট আফ্রিকা গভর্নেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটির জারনালে এই বৈপরীত্যের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন, অপরাধপ্রবণতা, দারিদ্র্য, নেতৃত্বের অভাব এবং একটি অ–প্রগতিশীল আঞ্চলিক ও উপ–আঞ্চলিক রাজনীতি ও ক্ষমতার খেলাকে দায়ী করেছে। উদাহরণস্বরূপ, নাইজেরিয়া ও নাইজার গত দশকে ছিদ্রযুক্ত সীমান্তরেখা, গ্রামীণ দস্যুতা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, যা নাইজেরিয়ার দারিদ্র্যসীমার নিচের ৭০ মিলিয়নেরও বেশি জনসংখ্যার জন্য খাদ্যের অপ্রতুলতা সৃষ্টি করেছে। তা সত্ত্বেও এখনও নাইজেরিয়া এবং অন্য প্রভাবিত দেশগুলিকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হচ্ছে। সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড ডেমোক্রেসি ইন ওয়েস্ট আফ্রিকা নামক সুশীল সমাজ সংস্থা দেখায় যে এই অঞ্চলের অভ্যন্তরে উত্তেজনাপূর্ণ হিংসাত্মক ও বিদ্রোহী হামলাগুলি প্রায়শই বিদ্যমান দুর্বল ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা, জাতিগত প্রোফাইলিং এবং দারিদ্র্যের কারণে হয়। শুধু উত্তর নাইজেরিয়াতেই দশ লক্ষেরও বেশি মানুষ পৈতৃক ভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার পাশাপাশি কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন ।
পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি ও খারাপ শাসনের ফলে হিংসাত্মক বিদ্রোহ, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, লোভ ও দমনমূলক নিরাপত্তা র্যাকেটের নতুন তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে। মনে করা হয় যে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বলপূর্বক সামরিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার ঘটনা দূরবর্তীভাবে এখানকার কিছু দেশে আপেক্ষিক শান্তিকে বিঘ্নিত করেছে। এমনটি সাম্প্রতিক মালির সামরিক অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল, যেখানে জুন্টার পরিবর্তনকালীন সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসক ও সাংবিধানিক নিয়ম প্রতিষ্ঠার জন্য অভ্যন্তরীণ জনসম্প্রদায়ের সমস্ত চাপকে উপেক্ষা করেছে। আফ্রিকা আরও অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেছে, এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলিকে উৎখাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই ঘটনা এই অঞ্চলের দুর্বলতা, এবং এই অঞ্চলের দেশগুলির সীমান্ত ও অভ্যন্তরে চরমপন্থা ও আন্তর্জাতিক অপরাধের বাড়বাড়ন্তের উপর আলোকপাত করে৷
সংঘাত এবং সশস্ত্র দস্যুদের দ্বারা বেসামরিক লোকদের নিরবচ্ছিন্ন হত্যার স্থায়ী ধরনটি, এবং নাইজেরিয়া জুড়ে বেশিরভাগ গ্রামীণ সম্প্রদায়ের জাতিগত সাফাই, ২০২১ সালে রেকর্ড ২,৬০০ মৃত্যুর কারণ হয়েছে, যা ২০২০ সালের তুলনায় ২৫০ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালে আরও বেসামরিক মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। বোকো হারাম, ইসলামিক স্টেট অফ ওয়েস্ট আফ্রিকা (আইএসডব্লিউএ), হত্যাকারী পশুপালক ও নিষিদ্ধ ইন্ডিজেনাস পিপল অফ বিয়াফ্রা (আইপিওবি) নামে এই সশস্ত্র চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলি সাব–সাহারান আফ্রিকার ভিতর ও বাইরের অন্যান্য মিলিশিয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে নাইজেরিয়াতে ব্যাপক নৃশংসতা চালিয়েছে।
এই জোয়ার শান্ত করা নাইজেরিয়া–সহ পশ্চিম আফ্রিকার ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলির সরকারগুলির জন্য একটি ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি তাদের গ্রামীণ ও শহুরে অভিযানের ক্ষেত্রগুলিকে প্রসারিত করার কারণে নাইজেরিয়ায় সশস্ত্র বাহিনীকে দুই–তৃতীয়াংশ রাজ্যে মোতায়েন করা হয়েছে, যা কর্মী ও হার্ডঅয়্যারের উপর প্রচণ্ড চাপ ফেলেছে। এই অ–রাষ্ট্রীয় কুশীলবদের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক বহুজাতিক যৌথ টাস্ক ফোর্সের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও বেসামরিক নাগরিকরা সন্ত্রাসবাদী হামলা ও পরিচয়ভিত্তিক হিংস্রতার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
প্রতিটি সন্ত্রাসবাদী হামলার সঙ্গে আসে অকল্পনীয় সংখ্যক হতাহত, বাস্তুচ্যুতি, ক্ষুধা এবং মানুষের অবমাননা,যার বেশিরভাগ শিকার নারী ও শিশুরা যাদের জরুরি যত্নের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যাঁরা তাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার শপথবদ্ধ তাঁরা প্রায়শই এঁদের পরিত্যাগ করেন।
নিহতের সংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি, মানুষের স্থানচ্যুতি ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়া, এবং সংক্রামক রোগের বিস্তার ও শিক্ষার অধিকারকে সক্রিয়ভাবে অস্বীকার একটি বাস্তবতা, যা আহত ব্যক্তিদের নিয়ে তৈরি একটি অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটাতে পারে। এটি বাকি বিশ্বকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে অ–প্রাথমিক সংস্পর্শ এবং বিশৃঙ্খলা ও টুকরো টুকরো হিংস্র গোষ্ঠীর সংখ্যাবৃদ্ধির মাধ্যমে।
প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ ও শহুরে উভয় বসতিতে বেসামরিক নাগরিক ও জনসম্প্রদায়ের উপর বিদ্রোহীদের আক্রমণের পুনরাবৃত্তি সরকার ও ক্ষতিগ্রস্ত, যাঁদের বেশিরভাগই এখন হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছেন, উভয়ের জন্যই মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলির যুদ্ধবিধ্বস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষেরা, বিশেষত মহিলা ও শিশুরা, যে তাঁদের আর্থ–সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের সম্মুখীন হচ্ছেন, এবং তাঁদের ভবিষ্যৎ যে সুতোয় ঝুলে আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর উদাহরণ হল উত্তর নাইজেরিয়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জল ও স্যানিটেশন–এর মতো প্রয়োজনীয় সামাজিক পরিষেবাগুলির ক্রমবর্ধমান ব্যাঘাত, যার লক্ষ্য সেই নারী ও শিশুদের জীবনের অধিকার যাঁদের বেশিরভাগই যৌন শোষণ ও যুদ্ধের অস্ত্রের শিকার।
পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দেশের জন্য অতিমারি পর্বটি তো খারাপ ছিলই, তার উপর মালি, বুরকিনা ফাসো, নাইজার ও নাইজেরিয়াতে, এবং সেখান থেকে ঘানা, বেনিন ও কোট ডি’আইভরির মতো প্রতিবেশী দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়া জিহাদি বিদ্রোহের ঘটনা অনেক বেড়ে গিয়েছে। সেইজন্য অবিলম্বে রাষ্ট্রপুঞ্জ, জি২০ দেশ, আফ্রিকা ইউনিয়ন, জি৫ সাহেল জয়েন্ট ফোর্স ও এই অঞ্চলের বহুজাতিক যৌথ টাস্কফোর্সের মতো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির হস্তক্ষেপ করা এবং শক্তিশালী নিরাপত্তা সহযোগিতা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
সাব–সাহারান আফ্রিকায় আপাতভাবে আসন্ন বিপর্যয়কে আটকাতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির এখনকার শান্তি বিনির্মাণ পদ্ধতিতে পরিবর্তন প্রয়োজন। যেমন, নাইজেরিয়ার মানব সম্পদের পুল ও ট্র্যাক রেকর্ডের কথা মাথায় রেখে শুধু নাইজেরিয়া নয়, আফ্রিকার বৃহত্তর সন্ত্রাসবাদের কর্মকাণ্ড কমানোর জন্য দেশটিকে জি২০–র পূর্ণ সদস্য হিসাবে স্বীকার করা অবশ্যই বিশ্বব্যাপী সংস্থার জন্য বেশ কাজের হবে। নাইজেরিয়ার সদস্যপদের অর্থ হবে জি২০–তে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলির যথাযথ প্রতিনিধিত্ব, এবং তার ফলে এই অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী জটিলতাগুলির সঠিক অনুধাবন। এক্ষেত্রে স্থিতিশীল বৈশ্বিক নীতিগুলির সমন্বয় এবং সুষম বৈশ্বিক বৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি ‘জি২০ দেশগুলির’ বৈশ্বিক গুরুত্বের কথা মাথায় রাখতে হবে।
বিশ্ব সংস্থাগুলির সিদ্ধান্ত গ্রহণের সীমাবদ্ধতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, বিশেষ করে যেহেতু আফ্রিকার নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি প্রথম বিশ্বের দেশগুলি প্রায়শই ছোট করে দেখে। এক্ষেত্রে জি২০ গত দশকে একটি সেতুনির্মাতা বলে প্রমাণিত হয়েছে, এবং যেখানে আফ্রিকা ও অন্যরা স্থায়ী প্রতিনিধিত্ব চাইছে সেই রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের একটি কার্যকর প্রক্সি হয়ে উঠেছে। উন্নত এবং উন্নয়নশীল না–হলেও অন্তত উদীয়মান দেশগুলিকে নিয়ে টেবিলে বসার মাধ্যমে জি২০ দেশগুলি জি৭৭+চিন–এর মতো গোষ্ঠীগুলি থেকে নিজেদের পার্থক্য তৈরি করেছে । এভাবে তারা আফ্রিকা ও আফ্রিকানদের জন্য আফ্রিকা–চালিত পদ্ধতির দক্ষ ও কার্যকর সুযোগ তৈরি করতে নতুন পথ তৈরি করেছে, যা এখানকার দেশগুলি ও বিশেষ করে জি২০–র শরিক–সহ বিশ্বশক্তিগুলির বৃহত্তর সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরতার মাধ্যমে আফ্রিকা মহাদেশে স্থিতিশীল শান্তি ও উন্নয়ন আনবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।
এই প্রবন্ধটি G20-Think20 Task Force 3: LiFE, Resilience, and Values for Wellbeing ধারাভাষ্য সিরিজের একটি অংশ