একাধিক চ্যালেঞ্জ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে কৃষি ও খাদ্য-উৎপাদন ব্যবস্থার স্থায়িত্বকে আপসের মুখে ফেলেছে। এর মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চ হার, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, দ্রুত হারে নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন এবং সংশ্লিষ্ট পরিবেশগত পরিবর্তন ও অবক্ষয়। ভারতে কৃষিক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হল ভূগর্ভস্থ জলের সম্পদ হ্রাস করার মতো পরিবেশগত চাপ-সহ জনসাধারণের দৈনন্দিন খাদ্যের চাহিদা মেটানো। পুষ্টির ফলাফলের উন্নতির লক্ষ্যে কৃষির উন্নয়নের জন্য ভূগর্ভস্থ জলের প্রাপ্যতা হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া এবং পূর্বাভাসিত খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের প্রভাবগুলিকে বিবেচনা করতে হবে যাতে কৃষি ও উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত নীতির নকশা এবং অভিযোজনে পর্যাপ্ত মতামত প্রদান করা যায়। স্থিতিশীল এবং স্থিতিস্থাপক কৃষি ব্যবস্থাকে উৎসাহ দেয় এমন পদক্ষেপ পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের জন্য কর্মসূচির পরিবেশগত প্রভাবগুলি বিবেচনা করে দেখা উচিত। দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশের কর্মসংস্থান প্রদানের ক্ষেত্রে কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলি দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২০ শতাংশ অবদান রাখে এবং ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ভারত জি২০ প্রেসিডেন্সির দায়িত্বে থাকার দরুন এ কথা স্পষ্ট যে, সকল মানুষের কল্যাণের জন্য একটি বাস্তবসম্মত বৈশ্বিক সমাধান খুঁজে বের করার উপরে জোর দেওয়া হবে। কৃষ্টি, পুষ্টি এবং এগুলির অন্তর্নিহিত সম্পর্ক দারিদ্র্যের অবসান ঘটানোর জন্য স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি ১) এবং সর্বপ্রকার অপুষ্টি নির্মূলকারী ও শূন্য ক্ষুধা অর্জনকারী স্থিতিশীল কৃষিপদ্ধতির লক্ষ্য অর্থাৎ এসডিজি ২ অর্জনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। এসডিজি ১২-ও কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থাৎ দায়িত্বশীল উৎপাদন এবং ভোগ যা ‘পরিবেশের জন্য জীবনধারা- লাইফ’-এর (লাইফস্টাইল ফর দি এনভায়রনমেন্ট – লাইফ) অধীনে মনোনিবেশ করার একটি অন্যতম ক্ষেত্র। পুষ্টিসমৃদ্ধ শস্যের উৎপাদন ও ব্যবহার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি ডাল এবং বাজরার মতো পুষ্টিসমৃদ্ধ শস্য উৎপাদনে সঠিক প্রণোদনা ও সহায়তা প্রদান এবং স্ব-ব্যবহারের প্রচার, বিশেষ করে বাজরা, ডাল, হেঁশেলের বাগানে এবং সাধারণ এলাকায় ফল ও সবজি, যা খাদ্য উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে… বিভিন্ন স্তরে মনোযোগ প্রয়োজন।
খাদ্যের বৈচিত্র্যকরণে উন্নতি এবং পুষ্টির ফলাফলকে প্রভাবিত করার জন্য, ডাল এবং বাজরা পুষ্টিসমৃদ্ধ ও ভারতীয় জনসংখ্যার খাদ্যাভ্যাসের উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। এগুলিও জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক শস্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত কৃষির চ্যালেঞ্জগুলির প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ, সরাসরি লাইফ-এর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ৷ শুঁটিজাতীয় ফসল হিসাবে পরিচিত ডাল মাটিতে নাইট্রোজেনের মাত্রা ঠিক রাখতে পারে, যার ফলে নাইট্রোজেন সারের উপর নির্ভরতা হ্রাস পায়। এগুলি ফসল চাষের চক্র বজায় রাখা এবং মিশ্র ফসলের জন্যও উপযোগী। কারণ এগুলি মাটিতে নাইট্রোজেন যৌগের ভাণ্ডারকে পুনর্সঞ্চিত করতে সক্ষম। তাই ডাল উৎপাদনকারী এলাকা বাড়ানোর পাশাপাশি আন্তঃমৌসুমী ফসল হিসেবে ডাল ব্যবহার করা স্থিতিশীল কৃষি চর্চা বাড়ানোর একটি সহজ পথ। এর ফলে পরবর্তী ফসলের জন্য নাইট্রোজেনভিত্তিক রাসায়নিক সারের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায় এবং রাসায়নিক কীটনাশক ও আগাছানাশকের ব্যবহার হ্রাসের কারণে ঘন ঘন ফসলের রোগচক্র বাধাগ্রস্ত হয়। ২০০৪-৫ এবং ২০১১-১২-এর এসএসএসও তথ্য ব্যবহার করে স্থানীয় ডালের সঙ্গে প্রধান পাঁচ রকম ডালের উৎপাদন ও ফলনের জন্য রাজ্য এবং অঞ্চলভিত্তিক শস্য উৎপাদনের একটি পরিস্থিতিগত বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। সেই বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে যে, ইন্টিগ্রেটেড স্কিম অফ অয়েল সিডস, পালসেস, অয়েল পাম অ্যান্ড মেইজ (আইএসওপিওএম), জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা মিশন (এনএফএসএম), রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা (আরকেভিওয়াই), দ্রুত হারে ডাল উত্পাদন কর্মসূচি (এ৩পি) এবং এনএফএসএম-এর অধীনে পালস ডেভেলপমেন্ট স্কিমের মতো একাধিক উদ্যোগ এবং ডালের আমদানি সত্ত্বেও মাথাপিছু ডালের প্রাপ্যতা প্রতিদিন ৪০ গ্রাম সুপারিশকৃত খাদ্য (আরডিএ) থেকে কম বলে জানা গিয়েছে। কিছু রাজ্যে (তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ এবং ছত্তিশগড়) গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে ভর্তুকিযুক্ত হারে ডাল সরবরাহ করার নীতির ফলে ডালের সামগ্রিক ব্যবহারের গড় বেড়েছে, যার ফলে প্রোটিন গ্রহণের মানে উন্নতি ঘটেছে। ডাল সম্পর্কিত কৃষিনীতিগুলিকে এ কথা সুনিশ্চিত করতে হবে যাতে উৎপাদন নীতিগুলিকে সংগঠিত বিপণন ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বিত করার পাশাপাশি সংগ্রহ সুনিশ্চিত করা, ডালের প্রজাতি সংক্রান্ত গবেষণা ও উন্নয়নে অধিকতর বিনিয়োগ এবং আমদানি সংক্রান্ত সময়োপযোগী সিদ্ধান্তকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে সক্ষম এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়।
ভারতে বাজরা উৎপাদন সংক্রান্ত একটি সমীক্ষায় ১৯৫০-৫১ থেকে ১৯৮০-৮১ সালের মধ্যে ইতিবাচক বৃদ্ধি লক্ষ করা গিয়েছে, যার নেপথ্যে রয়েছে মূলত জোয়ার, পার্ল মিলেট এবং ফিঙ্গার মিলেটের ব্যাপক উৎপাদন এবং পরবর্তী কালে সব ধরনের জোয়ার উৎপাদনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে। ১৯৫০-৫১ থেকে ২০১১-১২ সময়কালে হেক্টর প্রতি উচ্চ ফলনের কারণে বাজরা উৎপাদনে বৃদ্ধি লক্ষ করা গিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাজরা উৎপাদন বাড়াতে বেশ কিছু রাজ্যও উদ্যোগ গ্রহণ করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ওড়িশা রাজ্য সরকার ওড়িশা মিলেট মিশন শুরু করেছে— যা বাজরার উৎপাদন বাড়ানোর জন্য একটি সরকার-নাগরিক সমাজ-কৃষক সম্মিলিত উদ্যোগ। বাজরার চাহিদা তৈরি করতে কাজের পাশাপাশি উৎপাদন ব্যবস্থাকেও সমন্বিত করতে হবে। এর একটি ভাল উদাহরণ হল কর্নাটক, যেখানে প্রতিদিনের খাবারে বাজরা খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যবস্থার পাশাপাশি গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে বাজরা সরবরাহ করা হয়। বাজরের মূল্যবৃদ্ধির জন্য এবং বাজার মূল্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলার উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত শিল্প দ্বারা উৎপাদিত ভক্ষণযোগ্য খাদ্যদ্রব্যে বাজরার ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে।
ডাল এবং বাজরার মতো পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ শস্যের উপর মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি ফল ও শাকসবজির (এফভি) চাহিদাকেও উৎসাহিত করতে হবে যাতে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ঘাটতি মোকাবিলা করা যায় এবং অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। শিশুদের জন্য মিড ডে মিল জোগান দেওয়ার লক্ষ্যে ফল এবং শাকসবজি উৎপাদনের জন্য পুষ্টি বাগান গড়ে তোলার ব্যাপারে ভারতে সরকারি স্কুল এবং আইসিডিএস কেন্দ্রগুলিকে উত্সাহিত করা হয়। একটি ভারতীয় পরিবারে এফভি-র গড় ব্যবহার ১৪৯ থেকে ১৫২ গ্রাম/দিন/ব্যক্তি (তিনটি পরিবেশনের কম) পরিসীমার মধ্যে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) দ্বারা নির্ধারিত দৈনিক ৪০০ গ্রাম ফল ও শাকসবজি চাহিদার (পাঁচটি পরিবেশন) তুলনায় বহুলাংশেই কম।
কৃষিনীতি সম্পর্কিত গবেষণা এ কথাই তুলে ধরে যে, উন্নত পুষ্টির ফলাফলের জন্য স্থিতিশীল কৃষি অনুশীলনগুলিকে লাভবান করার উদ্দেশ্যে কৃষি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি ক্ষেত্রের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। ডাল, বাজরা, ফল এবং শাকসবজির মতো নির্দিষ্ট শস্যের বৃদ্ধি বা বিনিয়োগের প্রণোদনাগুলি খাওয়ার মাধ্যমে পুষ্টির পাশাপাশি পরিবেশের উপরেও প্রভাব ফেলে। কারণ এই শস্যগুলি চাষ করলে প্রাকৃতিক ভাবে মাটিতে নাইট্রোজেনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং এগুলি চাষ করতে গম, ধান ও আখের তুলনায় কম জলের প্রয়োজন হওয়ায় এগুলি অধিক পরিবেশবান্ধব। উত্তর ভারতে ডাল এবং বাজরার মতো জলবায়ু-সহনশীল শস্যের জন্য নীতি পরিবর্তনের একটি প্রয়োজন পরিলক্ষিত হয়েছে। বিদ্যমান নীতি ভারতে গম এবং চালের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে, কিন্তু এগুলি শীতের মাসগুলিতে পরালি পোড়ানর জন্য বায়ুর গুণমানের উপর এবং এই চাষে অতিরিক্ত জল দরকার হওয়ায় জলস্তর হ্রাসের কারণে জলের গুণমানের উপরেও প্রভাব ফেলে। ডাল, বাজরা এবং এফভি-র উৎপাদনে জোর দেওয়া শুধুমাত্র মাটির গুণমান উন্নত করতেই সাহায্য করবে না, তা ন্যূনতম বাড়তি খরচে জলস্তর ধরে রাখার ক্ষেত্রেও উল্লেখজনক ভাবে প্রভাব ফেলবে। দীর্ঘমেয়াদে এটি কৃষি, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং পরিবেশের সামগ্রিক উন্নয়নে কাজে লাগবে এবং এটিই সম্ভবত স্থিতিশীল ব্যবহারের উপর জোর দিয়ে ‘পরিবেশের জন্য জীবনধারা’-র লক্ষ্য পূরণের জন্য সর্বোত্তম উপায়। কীভাবে পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং জলবায়ু-সহনশীল শস্যের উৎপাদন উৎসাহিত করার মাধ্যমে স্থিতিশীল উৎপাদন ও চাহিদা অর্জন করা সম্ভব, জি২০ নেতৃত্বের মাধ্যমে তার উদাহরণ প্রদর্শন করতে পারে ভারত।
এই প্রতিবেদনটি ‘জি২০-থিঙ্ক২০ টাস্ক ফোর্স ৩: লাইফ, রেজিলিয়েন্স, অ্যান্ড ভ্যালুজ ফর ওয়েলবিয়িং’ সিরিজের অন্তর্গত।