ভারতের জি২০ প্রেসিডেন্সি: বৈশ্বিক কর্মসূচি নির্ধারণ

Sujan R. Chinoy

ভারতের জি২০ প্রেসিডেন্সি ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে। এটি ‘‌বসুধৈব কুটুম্বকম’‌ (বিশ্ব একটি পরিবার)–এর অন্তর্নিহিত ভাবনা অনুসরণ করবে, যা সর্বোত্তমভাবে ‘‌এক পৃথিবী, একটি পরিবার, একটি ভবিষ্যৎ’‌ মূলমন্ত্রের মধ্যে প্রতিফলিত। ভূ–রাজনীতি এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্রোতের মধ্যে আন্তঃসংযোগ অনস্বীকার্য, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রভাব অকাট্য। বালিতে জি২০ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে তাঁর মন্তব্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, লিঙ্গ সমতা, শান্তি ও নিরাপত্তা এবং সর্বজনীন সুবিধার জন্য প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের পূর্ণ ব্যবহারের মধ্যে যোগসূত্রের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন।

জি২০–র প্রধান ‘‌আইডিয়া ব্যাঙ্ক’‌ হিসেবে, জি২০–র Think20 (T20) এনগেজমেন্ট গ্রুপের কার্যক্রম ও আলোচনা সাতটি টাস্ক ফোর্সের মধ্যে বিস্তৃত।

‘‌সমষ্টিগত অর্থনীতি (‌ম্যাক্রো ইকোনমিকস)‌, বাণিজ্য, ও জীবিকা’‌ বিষয়ক প্রথম টাস্ক ফোর্সের কাছে মুদ্রা ও আর্থিক নীতি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সরবরাহ শৃঙ্খলের স্থিতিস্থাপকতার মধ্যে সুসঙ্গতি তৈরি করার বিষয়ে জি২০–র মধ্যে সমন্বয়ের জন্য সুপারিশ করার দায়িত্ব রয়েছে। লক্ষ্য হল অতিমারি–পরবর্তী সময়ে ‘‌একসঙ্গে পুনরুদ্ধার, শক্তিশালী পুনরুদ্ধার’‌–এর জন্য ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্সির সময় গৃহীত উদ্যোগগুলিকে আরও গতি দেওয়া। অকার্যকর ডব্লিউটিও প্রক্রিয়ার পটভূমিতে সরবরাহ শৃঙ্খল স্থিতিস্থাপকতা একটি সাধারণ উদ্বেগ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, এবং সঙ্গে সঙ্গেই জি২০ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতিতে শীর্ষ ২০টি অর্থনীতির মধ্যে ঐকমত্য তৈরির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হিসাবে কাজ করার দায়ভার তুলে নিয়েছে।

‘‌ডিজিটাল ফিউচারস’ সংক্রান্ত‌ টাস্ক ফোর্স একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করবে সকলের জন্য সাশ্রয়ী মূল্য ও নিরাপদ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে। এটি ডিজিটাল পরিষেবাগুলির সর্বজনীন আন্তঃকার্যযোগ্যতা নিয়েও আলোচনা করবে৷ সেই সঙ্গেই এটি ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও দক্ষতার সমস্যাগুলির সমাধান করবে, যে দুটি বিষয় অর্থনৈতিক বৃদ্ধির অবিচ্ছেদ্য অংশ৷

ভারতের জি২০ প্রেসিডেন্সির অন্যতম প্রধান ভিত্তি হল প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘‌লাইফস্টাইল ফর এনভায়রনমেন্ট’‌ বা পরিবেশবান্ধব জীবনশৈলীর ধারণা, যা ২০২১ সালে কপ২৬–এ উত্থাপিত হয়েছিল৷ বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে থাকে দেশগুলি, আর ব্যক্তিগত স্তরের আচরণ গুরুত্ব পায় না৷ পরিবেশবান্ধব জীবনশৈলী উদ্যোগের লক্ষ্য হল ব্যক্তিকে আলোচনার কেন্দ্রে রাখা এবং জাতীয়তা ও ভূগোল নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে সংবেদনশীল করা। যদি ব্যক্তিরা তাঁদের জীবনশৈলী বিকল্পগুলি সম্পর্কে আরও সচেতন হন এবং আরও দায়িত্বশীলভাবে কাজ করেন, তবে তা একটি বিশাল পার্থক্য তৈরি করতে পারে। পরিবেশবান্ধব জীবনশৈলীর উপর ফোকাস একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ, কারণ এটি সত্য যে অর্থনীতি ও জীবিকার উপর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলি বিশ্বের দুর্বল দেশগুলি সবচেয়ে বেশি অনুভব করে। ‘‌লাইফস্টাইল ফর এনভায়রনমেন্ট, রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড ভ্যালুজ ফর ওয়েলবিয়িং’‌ টাস্ক ফোর্সের সুপারিশ আসন্ন জলবায়ু সংকটকে রোধ করতে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃদ্ধির পরিসর তৈরি করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

‘‌রিফুয়েলিং গ্রোথ’‌ হবে সবুজ রূপান্তর সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের লক্ষ্য, কারণ এটি অতিমারি–উত্তর বিশ্বে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টার সঙ্গে আপস না–করে পরিচ্ছন্ন শক্তিতে মসৃণ রূপান্তরের পথ সুপারিশ করবে।

‘‌গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল অর্ডার’‌ টাস্ক ফোর্সটি বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থাকে পুনরায় সমন্বিত করার সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করবে। আজকের চ্যালেঞ্জ হল পরিকাঠামো–সহ সমসাময়িক অর্থনৈতিক চাহিদা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলিকে পুনর্গঠন করা। উদ্ভাবনী পদ্ধতির মাধ্যমে উন্নয়ন অর্থায়ন এবং সম্পদ সংগ্রহে বৃহত্তর প্রবেশাধিকার গুরুত্বপূর্ণ।

‘‌এসডিজি ত্বরান্বিত করা’‌ হল আরেকটি একক টাস্ক ফোর্সের ফোকাস, যা শক্তিশালী ও স্থিতিশীল সহযোগিতার মাধ্যমে ২০৩০ অ্যাজেন্ডা পূরণের জন্য নতুন নতুন পথ অন্বেষণ করবে। পৃথিবীর সীমাবদ্ধ সম্পদের পরিপ্রেক্ষিতে একটি বৃত্তাকার অর্থনীতির দিকে চলে যাওয়া এবং স্বেচ্ছাকৃত ও ভাবনাপ্রসূত উপভোগের অভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভবত বর্জ্য হ্রাস করতে এবং উন্নয়নের জন্য একটি পবিত্র চক্র গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

এটা মনে রাখা জরুরি যে বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানের সামঞ্জস্যপূর্ণ সংস্কার ছাড়া জি২০–র উল্লিখিত উদ্দেশ্যগুলির কোনওটিই অর্জন করা যাবে না। অতিমারি ও ইউক্রেন যুদ্ধ আবারও বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা প্রকাশ করেছে। জলবায়ু জরুরি অবস্থা ও ভূ–রাজনৈতিক উত্তেজনাসহ নতুন উঠে আসা সংকটগুলির মোকাবিলা করতে বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলির অক্ষমতা এই প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি আস্থা হারানোর কারণ হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যকর ও দায়বদ্ধ কাঠামোর সন্ধান করছে, যা আরও ভালভাবে সেই কাজ করতে পারে। এই লক্ষ্যে ‘‌সংস্কারকৃত বহুপাক্ষিকতা’‌ সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্স ‘‌বহুপাক্ষিকবাদ ২.০’‌ এর জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে চাইবে। একটি লক্ষ্যযুক্ত সংস্কার অ্যাজেন্ডার মধ্যে অবশ্যই রাখতে হবে মূল বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে, তা সে রাষ্ট্রপুঞ্জ হোক বা তার সংযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলি, যেমন হু, ডব্লিউটিও এবং আইএলও। আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে জি২০–র ভিতর থেকে আরও প্রতিনিধিত্বমূলক ও সমতাবাদী বহুমুখী বিশ্ব ব্যবস্থার জন্ম হবে বলে বিশ্ব সম্প্রদায়  প্রত্যাশা করতে পারে।

মোদীর সতর্কবার্তা যে ‘‌এখন যুদ্ধের যুগ নয়’‌ সর্বত্র অনুরণিত হয়। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা আজ বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও ভূখণ্ডগত বিভিন্ন ফ্রন্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জর্জরিত। মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব ও ক্রমবর্ধমান আস্থার ঘাটতি সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তোলে। বিশ্ব সম্প্রদায় একটি সন্ধিক্ষণের মধ্যে আছে। বিকল্পগুলির একটি হল জটিল ও অংশত একই ধরনের শিবিরগুলির মধ্যে একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধ শুরু করা, যা অগ্রগতিকে ক্ষুণ্ন করবে, এবং অপরটি হল অতিমারির ধ্বংস থেকে পুনরুদ্ধার করার জন্য হাত মেলানো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বড় চ্যালেঞ্জগুলির বিরুদ্ধে আরও কার্যকরভাবে লড়াই করা।

নভেম্বরে বালিতে শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত দ্য লিডার’‌স ডিক্ল্যারেশন শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখার গুরুত্বকে স্বীকার করেছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ জি২০ সদস্য রাষ্ট্র হিসাবে ভারত বহুপাক্ষিকতা ২.০–র জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে সমমনা দেশগুলির সঙ্গে কাজ করতে পারে৷

বর্তমান বছরটি ভারতের জন্য তার সত্য ও অহিংসার মূল্যবোধের পাশাপাশি যোগ, আয়ুর্বেদ ও বেদান্তের উত্তরাধিকার অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার একটি সুযোগ। বসুধৈব কুটুম্বকম, যা ভারতের নেবারহুড ফার্স্ট পলিসি ও ভ্যাকসিন মৈত্রীর পথপ্রদর্শক, তা  উচ্চতর মানবিক মূল্যবোধকে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে রাখে। এ এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যা ভারতের জি২০ প্রেসিডেন্সির সমস্ত দিকে ছড়িয়ে পড়বে বলে প্রত্যাশিত।

আমাদের T20 এনগেজমেন্ট গ্রুপ নতুন নৈতিকতা ও নীতিবোধ এবং স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা বিশ্বজুড়ে জনসম্প্রদায়ের সেবা করে, তার উপর ভিত্তি করে একটি রোডম্যাপ তৈরি করার প্রয়োজন সম্পর্কে তীব্রভাবে সচেতন। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হল বিপর্যয় স্থিতিস্থাপকতা ও ঝুঁকি প্রশমনে বিনিয়োগের জন্য আর্থিক মূলধন একত্র করা, বিশেষ করে দুর্বল দেশগুলিতে জীবিকার সুরক্ষার জন্য।

বালিতে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছিলেন, নারীদের অংশগ্রহণ ছাড়া বিশ্ব উন্নয়ন সম্ভব নয়। ভারত এটি উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতজুড়ে মহিলাদের জন্য দরজা খোলা হয়েছে৷ কন্যা শিশুর শিক্ষা থেকে শুরু করে মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ঋণ এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীতে নারীদের অন্তর্ভুক্তি,‌ ভারতীয় সমাজ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। জি২০ অ্যাজেন্ডাকেও সামনের বছরগুলোতে নারী নেতৃত্বাধীন উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ভারতের নেতৃত্বে জি২০ সমগ্র বিশ্বের জন্য, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের পক্ষে কথা বলতে পারে, ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারে, এবং প্রকৃত পরিবর্তনের জন্য একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।

অদ্বৈত দর্শন মানবজাতির যে মূলগত একতার কথা বলেছিল, আজ  তা বিশ্ব সম্প্রদায়কে অগ্রগতির পক্ষে বাধাস্বরূপ সমস্ত মতাদর্শগত, সামরিক ও অর্থনৈতিক বিভাজনকে অতিক্রম করতে সাহায্য করতে পারে, এবং আশাবাদের সঙ্গে সামনের দিকে তাকাতে সক্ষম করবে। অফুরন্ত রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি, মানানসই কল্পনা, সকলের প্রতি সহানুভূতি–সহ নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যা কিছু লাগে তা সবই ভারতের আছে।


লেখক ভারতের জি২০ প্রেসিডেন্সির T-20 চেয়ার, এবং মনোহর পারিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিস–এর ডিরেক্টর। মতামত ব্যক্তিগত


এই ভাষ্যটি প্রথমে ‘দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ প্রকাশিত হয়েছিল।