বিশ্ব জুড়ে সরকারগুলি ধারাবাহিক ধাক্কার প্রতিক্রিয়া হিসাবে খরচ অব্যাহত রাখায়, সরকারের ঋণ বিপজ্জনক ভাবে বাড়ছে। এটি কী ভাবে হ্রাস করা সম্ভব?
অতীতের সঙ্কট থেকে শিক্ষা
২০০০-এর দশকের শেষের দিকের গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস বা বিশ্বব্যাপী আর্থিক সঙ্কটের (জিএফসি) পরে জি২০ একটি সমন্বিত রাজস্ব উদ্দীপনা (কোঅর্ডিনেটেড ফিসকাল স্টিমুলাস) তৈরি করেছে, যা আমদানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একটি দেশের আর্থিক উদ্দীপনা অন্যদের কাছে ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে আরও কার্যকর হয়ে উঠেছে।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘাটতি পূরণের জন্য ডলার মুদ্রণ করতে সক্ষম হলেও এবং উন্নত অর্থনীতিগুলি (এই) কম হারে ঋণ পেলেও, উদীয়মান বাজারগুলি (ইএম) রেটিং-এর অবনমন, আন্তর্জাতিক ঝুঁকির আওতায় অর্থের বহিঃপ্রবাহ ও উচ্চ পরিমাণে অর্থগ্রহণ – যা উচ্চ ঋণে পর্যবসিত হয় – একাকী এ হেন সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার দরুন এ ক্ষেত্রে একটি মৌলিক অসামঞ্জস্য বিদ্যমান।
উচ্চ দ্বিমুখী ঘাটতি নিয়ে ভারত দুর্বল স্থানেই ছিল। সত্তর দশকের তেলের ধাক্কা এবং আশির দশক থেকে ভোগের দরুন ভারত সরকার ক্রমাগত ঋণ গ্রহণ করছিল। একাধিক সংস্কারের প্রবাহ সত্ত্বেও সুদ প্রদান এবং ভর্তুকির বোঝার ফলে ২০০০-এর দশকের উচ্চ বৃদ্ধির সময় পর্যন্ত রাজস্ব ঘাটতি বাড়তেই থেকেছে। কিন্তু জিএফসি উদ্দীপনা সমস্ত উন্নয়নকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। পতনশীল বৃদ্ধির কারণে বিলম্বিত সংশোধনগুলি্র কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে। অতিমারির সময় নেতিবাচক বৃদ্ধি শীর্ষে পৌছলেও, এ ক্ষেত্রে পরের বছরই অবস্থার পরিবর্তন হয়।
প্রত্যাশিত ঋণের পথ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৩ সালের বসন্ত অধিবেশন বা স্প্রিং মিট-এ ঋণ অনুপাতের জন্য প্রত্যাশিত পথ দর্শিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুপাত ২০২৭ সালের মধ্যে দেশটির ২০২০ সালের সর্বোচ্চ সীমা অর্থাৎ ১৩৪ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্রায় পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। চিনের অনুপাতও ১০০-র মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে এবং অন্য দেশগুলির অনুপাত ২-৫ শতাংশ হ্রাস পাবে, যা বিশ্বব্যাপী সরকারি ঋণকে ১০০ শতাংশ জিডিপি-র সমমাত্রায় স্থির রাখবে। এর পাশাপাশি এইগুলি ইএম এবং নিম্ন উপার্জনকারী দেশগুলির (এলআইসি) উপরে থাকবে। কিন্তু ক্রমাগত উচ্চ ঋণ ঝুঁকির মাত্রাকেও উচ্চই রাখবে।
ভারত: ঋণের অনুপাত ইতিমধ্যে দু’বছরে ৫ শতাংশ কমে ৮৯.২ থেকে ৮৪.২-তে এসে দাঁড়িয়েছে। আইএমএফ-এর অনুমান অনুযায়ী, এটি ২০২৭ সাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকবে। কিন্তু জিএফসি থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার পর ভারতীয় নীতি সফল ভাবে অতিরিক্ত মাত্রা এড়িয়ে গিয়েছে। চাহিদা ও সরবরাহের দিকগুলির মাঝে সমতা বিধান, কাউন্টারসাইক্লিক্যাল স্মুথিং, আর্থিক ও রাজস্ব নীতির মধ্যে ভাল সমন্বয় এবং অব্যাহত সংস্কার (বিসিসিআর) অস্থিরতার হ্রাস ঘটাবে এবং প্রকৃত হারগুলিকে মসৃণ ভাবে বৃদ্ধির হারের নীচে রাখবে – এটি এমন একটি সংমিশ্রণ, যা ঋণের অনুপাতকেও কম করে। এমনকি স্বল্প হার বৃদ্ধির পাশাপাশি ১০ বছরের জি-সেক প্রাপ্তি স্প্রেড বা ব্যবধান হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু মোট রাজস্বের ৪০ শতাংশ হারে আংশিক সুদ পরিশোধ ঋণ হ্রাসকেও প্রণোদনা জোগায়। এখানে বৃদ্ধি-ইতিবাচক পরিকাঠামোয় এক বৃহৎ অংশ নির্বাহ করা থেকে প্রণোদনা নিয়ে একটি ক্রমাগত আর্থিক সুদৃঢ়করণ ঘটতে পারে।
চাহিদা ও সরবরাহের দিকগুলির মাঝে সমতা বিধান, কাউন্টারসাইক্লিক্যাল স্মুথিং, আর্থিক ও রাজস্ব নীতির মধ্যে ভাল সমন্বয় এবং অব্যাহত সংস্কার (বিসিসিআর) অস্থিরতার হ্রাস ঘটাবে এবং প্রকৃত হারগুলিকে মসৃণ ভাবে বৃদ্ধির হারের নীচে রাখবে – এটি এমন একটি সংমিশ্রণ, যা ঋণের অনুপাতকেও কম করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সম্মুখীন। সরবরাহের সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে অতিমারির সময়ে অত্যধিক আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয় (উদার আয়ের সহায়তার জন্য মার্কিন ডলারের আধিপত্য ব্যবহার করে)। উচ্চ ঋণের ফলে ঘাটতি-সহ পুঁজির পুনর্বণ্টন করা বিপজ্জনক – এটিকে অবশ্যই কর দ্বারা অর্থায়িত হতে হবে। এর ফল স্বরূপ যখন মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায়, তখন আর্থিক নীতি দেরিতে শুরু হলেও অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। ডলারের মূল্য রক্ষার জন্য মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা তার আধিপত্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু হার পরিবর্তনগুলিকে তথ্য নির্ভর হতে হবে এবং প্রভাবহীন ক্ষেত্রগুলিকে ফলপ্রসূ হওয়ার মতো সময় দিতে হবে। তীক্ষ্ণ পরিবর্তনগুলি সকল দেশের জন্য মূলধন প্রবাহ এবং বিনিময় হারে অতিরিক্ত অস্থিরতার জন্ম দেয়, যা ডলারের প্রতি আস্থার হ্রাস ঘটায়। তারা লুক্কায়িত আর্থিক ঝুঁকিগুলিকেও প্রকট করে তোলে। প্রুডেন্সিয়াল রেগুলেশন আর্থিক নীতি দ্বারা প্ররোচিত আর্থিক খাতের বিচ্যুতিগুলির মোকাবিলা করতে পারে। তবে কোনও সঙ্কটের সময়ে এটির কড়াকড়ি করা সম্ভব নয়। এটি ব্যবহারের সর্বোত্তম উপায় হল সঙ্কট-পূর্ববর্তী সময়। ছোট ব্যাঙ্কগুলির জন্য শিথিল করা হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাঙ্ক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য এই ধরনের কোনও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়নি।
ক্রমবর্ধমান সুদের হারও সরকারি ঋণের জন্য একটি বড় সমস্যা। মার্কিন সরকারি ঋণ ২০০২কিউ১-এর ৫৫.৭ শতাংশ থেকে দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে অতিমারি পরবর্তী সময়ে ২০২১কিউ১-এ জিডিপি-র ১২৬.১ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে প্রদেয় সুদ জিডিপি-র প্রায় ১.৫ শতাংশ থেকেছে, কারণ সুদের হার খুবই কম ছিল৷ কিন্তু ইউএসজি ১০ বছরের হার যা অতিমারির আগে ১ শতাংশ ছিল, তা ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ৪.২৫ শতাংশে পৌঁছয়। ১৯৮১ সালে এই মাত্রা সর্বোচ্চ ১৫.৪ শতাংশে পৌঁছেছিল। এর ফল স্বরূপ ১৯৯১কিউ১-২ প্রদেয় সুদ বেড়ে জিডিপি-র ৩.১৬ শতাংশে দাঁড়ায়। ১৯৮০-র দশকে ঋণ পরিষেবা হিসাবে অগ্রহণযোগ্য ২৫ শতাংশ রাজস্ব প্রাপ্তির ফলে বাজেট প্রয়োগ আইন বা বাজেট এনফোর্সমেন্ট অ্যাক্ট ব্যয়ের উপর সীমাবদ্ধতা এবং পেগো ব্যবস্থার দিকে পরিচালিত করে, যাতে অর্থায়ন লব্ধ হলে তবেই একটি নতুন প্রকল্প শুরু করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি, অ্যালান গ্রিনস্প্যান যেমন আর্থিক কড়াকড়িকে সমর্থন করার জন্য হার হ্রাস করলে বিল ক্লিনটনের সময়কালে ঋণের পরিমাণ কমে এসেছিল (ফেড চেয়ারম্যান পল ভলকারের অধীনে বিপরীত সংমিশ্রণে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল)।
বর্তমান অনুমান অনুযায়ী প্রকৃত হারের পরিমাণ কমই থাকবে। কিন্তু এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে ডলারের জন্য তা ফলপ্রসূ হবে না, যেহেতু নমিনাল রেট বা ন্যূনতম হার মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। হার বৃদ্ধি পেলে অতিরিক্ত উচ্চ ঋণ প্রদেয় সুদের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারে। এমনকি ইএমগুলিও ডলার অ্যাসেট হোল্ডিং হ্রাস করলে এগুলি বৃদ্ধি পাবে। অন্য কোনও মুদ্রা এতটা শক্তিশালী নয়। কিন্তু অর্থপ্রদানের উদ্ভাবন, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কে নিয়ন্ত্রণ জারি করার অনুমতি দেয়। এমনকি ভূরাজনীতি ডলারের ব্যবহার হ্রাস করতে পারে। একটি নিয়মভিত্তিক গণতন্ত্র হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার আধিপত্য ধরে রাখতে, অন্যদের এবং নিজের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব কমাতে, এমনকি আর্থিক-অর্থনৈতিক নীতির চরম পরিস্থিতি এড়াতে, নিয়মগুলিকে সম্মান করতে এবং একপাক্ষিকতা থেকে দূরে থাকতে এগুলির প্রয়োজন। আরও প্রতিযোগিতা সম্ভবত শৃঙ্খলা আরোপ করবে, যা নীতির উন্নতি ঘটাতে এবং মার্কিন ঋণের বোঝা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
ঋণগ্রহীতারা নিজেরাই বহুপাক্ষিক ব্যাঙ্কগুলিকে ঋণ পরিশোধ করতে চায়। কারণ এগুলিতে ঋণের হার কম এবং অন্যান্য ঋণের মূল্য বহুপাক্ষিক ঋণের আওতার বাইরে থাকে।
এলআইসি এবং ইএম: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্ব ব্যাঙ্ক অনুমান করেছে যে, এলআইসিগুলির ১৫-৬০% ঋণ সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে বা ঋণ সঙ্কটে পড়তে চলেছে। ইএম সার্বভৌম বন্ড থেকে প্রাপ্তির পরিমাণ ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৮ শতাংশ হয়েছে; উচ্চ ঋণযুক্ত ইএম-এর ২৫ শতাংশ ঋণ গ্রহণের খরচ ছিল খুব বেশি। কিন্তু ঋণ কমানোর জন্য জি২০ ২০২০ অভিন্ন সাধারণ কাঠামো এখনও পর্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি।
ঋণ পুনর্গঠনকে কার্যকর করার জন্য এটিকে উদারপন্থী হতে হবে; কিন্তু যেহেতু বেসরকারি ঋণদাতা এবং দ্বিপাক্ষিক ঋণের অংশীদারিত্ব বিশালাকার, তাই এই ঋণদাতাদের প্যারিস ক্লাব আর প্রভাবশালী নয়, যা চুক্তিটিকে কঠিন করে তুলছে। চিনারা ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানকেও হেয়ার কাট প্রভাবের আওতায় আনার উপর জোর দিচ্ছে। এটি এড়িয়ে যাওয়ার একটি পথ হতে পারে আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাঙ্কগুলিতেও হেয়ার কাট ছাড়ের আওতায় আনা এবং ঋণ সম্প্রসারণের জন্য আরও কার্যকর ভাবে মূলধনকে ব্যবহার করার শর্ত তাদের উপর প্রয়োগ করা। ঋণগ্রহীতারা নিজেরাই বহুপাক্ষিক ব্যাঙ্কগুলিকে ঋণ পরিশোধ করতে চায়। কারণ এগুলিতে ঋণের হার কম এবং অন্যান্য ঋণের মূল্য বহুপাক্ষিক ঋণের আওতার বাইরে থাকে।
ক্রেডিট ডাটাবেসে ব্যক্তিগত অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা এবং পুনর্গঠনের অধীনে সম্পদ আটককে প্রতিরোধ করাও সাহায্য করতে পারে। জলবায়ু সম্পর্কিত যৌথ কর্মসূচি ঋণচুক্তিগুলির প্রদেয় অর্থের পরিমাণ কমাতে পারে। জনকল্যাণকর উদার জলবায়ু অর্থায়ন ইএম-এর আর্থিক চাপও কমাতে পারে। ইএম অর্থায়নের উচ্চ ব্যয় মূলত মুদ্রার ঝুঁকি দ্বারা চালিত হয়, যা প্রায়শই বাস্তবায়িত হয় না। পোর্টফোলিও বিমা এবং পুনঃবীমা বা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের অদলবদলের উপর ভিত্তি করে উদ্ভাবনী দীর্ঘমেয়াদি মুদ্রার পরিসর – যা দেশজ তথ্য আইএমএফ-এর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার ফলে ঋণের মূল্য হ্রাস পেতে সাহায্য করে – সম্প্রসারিত করা যেতে পারে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এ।