ভারতের জি২০ প্রেসিডেন্সির জন্য নীল অর্থনীতির (ব্লু ইকোনমি, সংক্ষেপে বিই) অপরিহার্যতা আরও বেশি করে প্রতীয়মান, কারণ বৈশ্বিক উত্তরের তুলনায় বৈশ্বিক দক্ষিণের জন্য বিই–র একটি পৃথক অর্থ আছে। এই পার্থক্য প্রায়শই পর্যাপ্তভাবে বোঝা যায় না। ইন্দোনেশিয়ার থেকে ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব গ্রহণ করা তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ভারত জি২০–র সভাপতিত্বের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বৈশ্বিক দক্ষিণের ত্রয়ীর (ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও ব্রাজিল) ঠিক মাঝখানে জায়গা পেয়েছে। তাই বৈশ্বিক দক্ষিণের দৃষ্টিকোণ থেকে বিই–র তাৎপর্য তুলে ধরা ভারতীয় প্রেসিডেন্সির দায়িত্ব।
এখনও পর্যন্ত বিই–র তেমন কোনও সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। ইউরোপীয় কমিশনের সাধারণ সংজ্ঞা অনুযায়ী সামুদ্রিক ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কিত সমস্ত অর্থনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গেই বিই সম্পর্কিত হলেও বিশ্বব্যাঙ্ক ও রাষ্ট্রপুঞ্জের সংজ্ঞাগুলি বিই আলোচনায় স্থিতিশীলতার মাত্রাকে অন্তর্ভুক্ত করে।
যাই হোক না কেন, বিই–র বৈশ্বিক গুরুত্ব এই সব তথ্য থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে বিশ্ব বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ সমুদ্রনির্ভর, বিশ্বের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ উপকূলীয় অঞ্চলের কাছে বাস করেন, এবং ৩ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ তাঁদের জীবিকার জন্য মহাসাগরের উপর নির্ভরশীল। বিই–র ‘প্রাকৃতিক মূলধন’–এর মূল্য প্রায় ২৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুমান করা হয়েছে, এবং উৎপাদিত পণ্য ও পরিষেবার বার্ষিক মূল্য প্রতি বছর ২.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে হিসাব করা হয়েছে, যা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) নিরিখে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম অর্থনীতির সমতুল্য।
বৈশ্বিক দক্ষিণের জন্য সমুদ্রের গুরুত্ব বোঝা যায় উপকূলীয় জনসম্প্রদায়গুলি যে বিভিন্ন বাস্তুতান্ত্রিক পরিষেবা ব্যবহার করে জীবিকা সংগ্রহ করেন তাতে সমুদ্রের ভূমিকা থেকে।
মিলেনিয়াম ইকোসিস্টেম অ্যাসেসমেন্ট (সহস্রাব্দ বাস্তুতন্ত্র মূল্যায়ন) প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের জৈব কার্যকারিতার মাধ্যমে নীল অর্থনীতির প্রদত্ত পরিষেবাগুলির কথা তুলে ধরে। এগুলিকে সংস্থান পরিষেবা (মৎস্য, নির্মাণসামগ্রী, খাদ্য, ইত্যাদি), নিয়ন্ত্রণ পরিষেবা (কার্বন সিঙ্ক ও কার্বন সিকোয়েসট্রেশন, ক্ষয় প্রতিরোধ, চরম ঘটনা সংযমন, ইত্যাদি) সাংস্কৃতিক পরিষেবা (পর্যটন, বিনোদন, নান্দনিক, ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ), এবং সহায়ক পরিষেবা (প্রাণী ও স্থানীয়দের জন্য জীবন–চক্র রক্ষণাবেক্ষণ, এলিমেন্ট ও নিউট্রিয়েন্ট চক্র) হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে।
ইকনমিক্স অফ ইকোসিস্টেমস অ্যান্ড বায়োডাইভারসিটি (টিইইবি) এই বাস্তুতান্ত্রিক পরিষেবাগুলিকে ‘দরিদ্রের জিডিপি’ হিসাবে অভিহিত করেছে, কারণ গরিবের জীবিকা ও আয়ের বেশিরভাগই এই বাস্তুতান্ত্রিক পরিষেবাগুলি থেকে আসে। বৈশ্বিক দক্ষিণের দরিদ্র উপকূলীয় জনসম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তা ছাড়া, অসংখ্য মহাসাগর–ভিত্তিক শিল্পের দ্রুত বিকাশের পাশাপাশি সমুদ্র হয়ে উঠেছে পরবর্তী বড় অর্থনৈতিক দিগন্ত, যা বায়ুশক্তি, অফশোর অ্যাকুয়াকালচার, সামুদ্রিক খনি ও সামুদ্রিক জেনেটিক বায়োটেকনোলজির মতো কার্যকলাপের মাধ্যমে বৈশ্বিক দক্ষিণের ভবিষ্যৎ বৃদ্ধির চালক হতে চলেছে।
এই প্রেক্ষাপটে এ কথা মনে রাখা দরকার যে দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের ক্ষুদ্র কারিগরি মৎস্য চাষ বৈশ্বিক উৎপাদনে ৮০%–এরও বেশি অবদান রাখার দৌলতে বৈশ্বিক খাদ্য ঝুড়িতে এখন একটি প্রধান অবদানকারী হয়ে উঠেছে। মৎস্যক্ষেত্র ভারতে ১৫ মিলিয়ন মানুষকে কাজ দেয় এবং বিশ্বের মাছ উৎপাদনে তা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে (৬.৩%) (২০১৫–১৬ সালে ১০ বিলিয়ন ভারতীয় রুপি)। এমনকি, উপকূলীয় ও সামুদ্রিক পর্যটন, যা বিশ্বের জিডিপি–র ৫%–এর প্রতিনিধিত্ব করে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে আনুমানিক ৮.৫ মিলিয়ন মানুষের জন্য (২০১০ সালে ছিল ৭ মিলিয়ন) কাজের সুযোগ তৈরি করবে বলে আশা করা হচ্ছে, তা দক্ষিণে বড় আকারের কর্মসংস্থান ও জীবিকা প্রদানকারী একটি বিশিষ্ট ক্ষেত্র।
বিই–র সম্ভাব্য ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার এখনও অনেক দূরের কথা। তার কারণ প্রাথমিকভাবে আর্থিক ও মানবিক পুঁজি সংক্রান্ত নীল অর্থনীতিতে উদ্ভাবনের প্রশ্নে বিনিয়োগের অভাব। কেপিএমজি–র সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজি ১৪ (জলের নিচে জীবন) হল বেসরকারি ক্ষেত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যূনতম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এসডিজি–গুলির মধ্যে একটি, এবং মাত্র ১৮ শতাংশ কোম্পানি একে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
যেখানে এসডিজি ১৪–র তহবিলের জন্য প্রতি বছর আনুমানিক ১৭৪.৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন, সেখানে মাত্র ২৫.০৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বার্ষিক ব্যয় হয়, যা প্রতি বছর ১৪৯.০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থায়নের ব্যবধান প্রদর্শন করে। এই বিরাট আর্থিক ঘাটতি বিশ্বের জীবিকা নির্বাহের জন্য সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল ক্রমবর্ধমান অরক্ষিত জনসংখ্যার জন্য দুঃসংবাদ। তাই সরকার ও সংস্থাগুলির নীল অর্থনীতির উদ্ভাবন–ক্ষমতা ও সম্প্রসারণের দিকে মনোনিবেশ করা অপরিহার্য, যা স্বল্প–কার্বন স্থিতিশীল ভবিষ্যতের লক্ষ্যে একটি পরিচ্ছন্ন পথ দেখাতে পারে। এসডিজি ১৪ অর্থায়নের জন্য আরও উদ্ভাবনী ‘নীল আর্থিক পণ্য’, যেমন নীল বন্ড ও ঋণ এবং নীল ডেরিভেটিভ পণ্যগুলির কথা ভাবতে হবে।
বিই–র বৈশ্বিক গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে, এবং আরও বেশি করে বিশ্বব্যাপী দক্ষিণের বিপদাপন্ন সমুদ্রনির্ভর জনসম্প্রদায়গুলির জন্য, ভারতের জি২০ প্রেসিডেন্সি অনন্য সুযোগ নিয়ে এসেছে বৃদ্ধি, সবুজ অর্থনীতি ও সামাজিক ন্যায্যতার উদ্দেশ্যে নীল অর্থনীতি–কে অগ্রাধিকার দেওয়ার।
এমন উদ্বেগ রয়েছে যে সুনির্দিষ্ট নীতি বা নির্দেশিকার বিশদ বিবরণের অনুপস্থিতিতে জাতীয় নীল অর্থনীতি, বা স্থিতিশীল সমুদ্র অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অনুসরণ, যেখানে পরিবেশগত স্থায়িত্ব ও সামাজিক ন্যায্যতার দিকে খুব কম মনোযোগ দেওয়া হয়। সামুদ্রিক সহযোগিতার আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংলাপে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নীল অর্থনীতিতে ভারতের সম্পৃক্ততা বাড়ছে।
বলা প্রয়োজন যে সমুদ্র যেমন একদিকে বার্ষিক নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইডের প্রায় এক–তৃতীয়াংশ শোষণ করে, তেমনই সেখানে উপস্থিত লোহার মাত্রা সহায়তা করে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের বিকাশে, যা কার্বন সঞ্চয়ের একটি মূল উপাদান। তা ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের খরচ ও আয়তনগত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তরঙ্গশক্তি কিন্তু সবুজ শক্তির উৎস হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে, ১ নভেম্বর ২০২১–এ গ্লাসগোতে কপ২৬–এ লাইফ (পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ জীবনশৈলী)–এর জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আহ্বান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই বিষয়টি সরবরাহকারী, সমর্থনকারী ও নিয়ন্ত্রণকারী পরিষেবাগুলির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা মানুষের বেঁচে থাকার ভিত্তি তৈরি করে। ভারতীয় প্রেসিডেন্সির অধীনে জি২০–র সামুদ্রিক ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের সংরক্ষণকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা উচিত। এ কথাও উপলব্ধি করা দরকার যে নীল অর্থনীতি নিছক একটি পরার্থবাদী অভিপ্রায় নয়, বরং বৈশ্বিক দক্ষিণের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি উন্নয়ন সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা।
এই ভাষ্যটি প্রথম ‘ইন্ডিয়া টুডে’–তে প্রকাশিত হয়েছিল।