ভারতের জি২০ সভাপতিত্বের আর্থিক কর্মসূচি

Barry Eichengreen | Pooman Gupta

১ ডিসেম্বর ভারত জি২০-র সভাপতিত্ব গ্রহণ করেছে। নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য এটি উপযুক্ত সময় নয়। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা মাথা চাড়া দিয়েছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ জ্বালানি, খাদ্য এবং পণ্যের বাজারের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী করে চলেছে। জলবায়ু সঙ্কট ঘনিয়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চিন উত্তেজনা বৈশ্বিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সর্বোত্তম প্রস্তুতি নিয়েও জি২০ সভাপতিত্ব এই সব সমস্যার সার্বিক সমাধান করতে পারবে না। অনিশ্চয়তা এবং আন্তর্জাতিক বিভাজন অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রচেষ্টায় বাধা সৃষ্টি করবে।

কিন্তু আধুনিক আন্তর্জাতিক আর্থিক সমস্যা এ ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম। ১৯৯০-এর দশকে এশীয় আর্থিক সঙ্কটের পর থেকে আধুনিক আন্তর্জাতিক আর্থিক সমস্যাগুলি নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করা হয়েছে এবং বর্তমানে অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এক বিস্ময়কর মাত্রায় ঐকমত্য পরিলক্ষিত হয়েছে। এ কথা আশ্চর্যের নয় যে, ভারতীয় সভাপতিত্বের জন্য একটি অনুসরণযোগ্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি রয়েছে।

প্রথমত, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের মুদ্রার বিনিময় সীমা এবং বিশেষ করে ফেডারেল রিজার্ভ দ্বারা ডলারের বিনিময় আর্থিক বাজারকে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, ফেডারেল এবং অন্য কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি শুধুমাত্র সীমিত অংশীদারদের জন্যই এই সুবিধাগুলি প্রদান করে।

তাই জি২০-র উচিত কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলিকে তাদের বিনিময়-শৃঙ্খল প্রসারিত করতে এবং অস্থায়ী ব্যবস্থাকে স্থায়ী করে তুলতে উত্সাহিত করা। যেহেতু অনেক সম্ভাব্য প্রাপকেরই অন্য অনেক ধরনের এবং কখনও কখনও জামানত হিসাবে অ-নগদী সম্পত্তি রয়েছে, তাই ফেডারেল ব্যালান্স শিটের ঝুঁকি না নিয়েই অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলিতে বিনিময় প্রসারিত করতে সক্ষম।

দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নমনীয় ক্রেডিট লাইন এবং সতর্কতামূলক ও নগদ সীমা উদীয়মান বাজারগুলিকে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের বিনিময়ের সুবিধা ছাড়াই সাহায্য করার জন্য নির্মাণ করা হলেও সেই প্রত্যাশা পূরণ করেনি। মাত্র আটটি দেশ এই সুবিধার জন্য অনুমোদন চেয়েছে এবং মাত্র তিনটি দেশ বাস্তবে তা কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছে। দৃঢ় নীতিসম্পন্ন দেশগুলি এমনটা করার প্রয়োজন অনুভব করে না। অন্য দেশগুলি আশঙ্কা করছে যে, আবেদন করলে বিনিয়োগকারীদের কাছে নেতিবাচক সঙ্কেত পৌঁছবে।

দৃঢ় নীতিসম্পন্ন দেশগুলির তাই প্রতিকূল সঙ্কেত প্রভাবকে দুর্বল করার উপায় হিসাবে আকস্মিক শর্তসাপেক্ষ সীমার জন্য আবেদন করা উচিত। আরও ভাল হয় যদি আবেদন করার আগেই আইএমএফ একতরফা ভাবে দেশগুলিকে পূর্ব নির্বাচিত করতে পারে। এই সীমা স্বয়ংক্রিয় ভাবে বিতরণক্ষম হয়ে উঠতে পারে যখন একটি ‘গ্লোবাল সেলঅফ ইভেন্ট’ আইএমএফ কর্মীদের দ্বারা চিহ্নিত এবং নির্বাহী বোর্ড দ্বারা প্রত্যয়িত হয়।

তৃতীয়ত, ২০২১ সালে অনুমোদিত ৬৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের আইএমএফ স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর, তহবিলের রিজার্ভ অ্যাসেট) মূল প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পুনরায় বরাদ্দ করা যেতে পারে। উচ্চ আয়ের দেশগুলির এসডিআর ঋণ দেওয়ার জন্য আইএমএফ একটি রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেনেবিলিটি ট্রাস্ট (স্থিতিস্থাপক এবং স্থিতিশীলযোগ্য) তৈরি করেছে। কিন্তু ঋণ নেওয়ার জন্য কোনও সরকারকে আইএমএফ কর্মসূচির কাছে আবেদন জানাতে হবে, যা একটি প্রতিবন্ধকতা হয়ে ওঠে। যেহেতু একটি দেশের আইএমএফ কোটার ১৫০% লভ্যতা সীমাবদ্ধ, তাই তহবিল সর্বাধিক ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পুনরায় বরাদ্দ করতে সক্ষম। সবচেয়ে খারাপ হল, মাত্র ছ’টি সদস্য তাদের এসডিআর ঋণ দেওয়ার জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, যার মূল্য হল মাত্র ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। স্পষ্টতই, ১৫০% ক্যাপের মাত্রা প্রত্যাহার করা উচিত এবং অন্য জি২০ সরকারগুলির ছয় অগ্রগামী দেশের সঙ্গে যোগ দেওয়া এবং ট্রাস্টে অবদান রাখা জরুরি।

চতুর্থত, অনেক নিম্ন আয়ক্ষম দেশ যখন বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করে, তখনও বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় থাকে না। কারেন্সি হেজিং ব্যবস্থাগুলি সংশ্লিষ্ট বিনিময় হারের ঝুঁকি কমাতে অনেক দূর এগোতে সক্ষম। কারেন্সি এক্সচেঞ্জ ফান্ড এনভি, বা টিসিএক্স-এর মতো সংস্থাগুলি দেখিয়েছে যে, কীভাবে এই ধরনের উপকরণগুলি আন্ডাররাইট করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে কম খরচে আর্থিক সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়।

টিসিএক্স চারটি জি২০ সরকার দ্বারা গৃহীত মূলধনের সঙ্গে আংশিকভাবে তার মুদ্রার বিনিময়কে সমর্থন করে। কিন্তু এর ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের মূলধন ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের বিনিময়ের ব্যালান্স শিটকে সমর্থন জোগায়। টিসিএক্স-এর বৃদ্ধিকে সূচিত করতে পুঁজি জোগানোর নিরিখে একটি জি২০ চুক্তি উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য মুদ্রা ভিন্নতা সমস্যার সমাধানে সফল হতে পারে।

পঞ্চমত, জলবায়ু পরিবর্তন উন্নয়নশীল বিশ্বকে বিশেষ ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়, যখন দেশগুলি তাদের বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে অক্ষম হলে এবং তাদের পুঁজি বাজারে প্রবেশাধিকার হ্রাস পেলে একটি জলবায়ু সম্পর্কিত বিপর্যয় আর্থিক বিপর্যয়ে পরিণত হতে পারে। জি২০-র একটি ব্যয়বহুল জলবায়ু কর্মসূচির ক্ষেত্রে অর্থপ্রদান স্থগিত করার ধারা-সহ বন্ডের বিস্তৃত বণ্টনকে উত্সাহিত করা উচিত, যেমনটা সর্বপ্রথম দেখা গিয়েছে বার্বাডোসের বিপর্যয় বন্ডের ক্ষেত্রে। ফিচ রেটিং একটি বাজারের অস্তিত্বকে সুনিশ্চিত করে বার্বাডোসের বন্ডকে বি রেটিং দিয়েছে। কিন্তু সেই বাজার আরও গভীর এবং তরলীকৃত হবে যদি অন্যান্য সরকারও এই ধরনের বন্ড জারি করে।

সর্বোপরি, জি২০ দ্বারা সম্মত ঋণ সংস্কারের জন্য সাধারণ কাঠামো নির্ণয় করা আবশ্যক। সেই কাঠামোটি তৈরি করা হয়েছিল অন্যতম মূল পাওনাদার দেশ চিন সরকারকে আলোচনার টেবিলে একটি আসন দেওয়ার জন্য এবং এ কথা সুনিশ্চিত করার জন্য, যাতে সমস্ত ঋণদাতাই তুলনামূলক আচরণ করে। তবুও দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে মাত্র তিনটি দেশ সাধারণ কাঠামোর মাধ্যমে ঋণ ত্রাণের জন্য আবেদন করেছে এবং শুধুমাত্র একটি দেশ, চাদ, প্রকৃতপক্ষে তা পেতে সক্ষম হয়েছে।

ত্রাণের বিষয়টি  এখন জরুরি হয়ে উঠেছে । বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং আইএমএফের প্রধানরা পরামর্শ দিয়েছেন যে, সাধারণ কাঠামোর অধীনে মকুব প্রার্থী দুর্দশাময় ঋণগ্রহীতা দেশগুলিকে ঋণ পরিষেবা প্রদান স্থগিত করার সময় জাতীয় আদালতের দ্বারা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা থেকে বিধিবদ্ধ সুরক্ষা প্রদান করা উচিত। আইনি ঝুঁকির হাত থেকে মুক্তি পেলে আরও কয়েকটি দেশ আবেদন জানাবে। কিন্তু ঋণদাতা দেশের সরকারগুলিকে আইন বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এই ধরনের সুরক্ষা প্রদান করতে হবে। জি২০-র উচিত এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া।

আসলে এই কর্মসূচির উপাদানগুলি নিয়ে খুব কমই মতবিরোধ রয়েছে। এটির বাস্তবায়ন জি২০-র কর্মসূচির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ এবং এটি গোষ্ঠীটিকে তার উদ্দেশ্য পুনর্নবীকরণ করতে সাহায্য করবে।


এই ভাষ্যটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় প্রজেক্ট সিন্ডিকেট-এ।