ক্যাপশন: জাতীয় পতাকার রং ছাড়াও লোগোটিতে সাতটি পাপড়ি-সহ একটি পদ্মকে চিত্রিত করা হয়েছে, যার উপর প্রতীকীভাবে পৃথিবী, তার মহাসাগর এবং সাতটি মহাদেশ একটি গ্রহপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। (ইউটিউব ভিডিওগ্র্যাব / নরেন্দ্র মোদী)
৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জি২০-র ভারতের সভাপতিত্বের জন্য প্রতীক, ওয়েবসাইট এবং মূল ভাবধারার সূচনা করেন এবং এর মাধ্যমে ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া দেশের জি২০ সভাপতিত্বের মূল সুরকে এক তারে বেঁধে দেন। মোদীর স্পষ্ট আহ্বান ছিল ‘এক বিশ্ব, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’, যা ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শব্দবন্ধ দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়েছে। জাতীয় পতাকার রং ছাড়াও লোগোটিতে সাতটি পাপড়ি-সহ একটি পদ্মকে চিত্রিত করা হয়েছে, যার উপর প্রতীকীভাবে স্থাপিত পৃথিবী, তার মহাসাগর এবং সাতটি মহাদেশ একটি গ্রহপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। মোদী এই বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন যে, ভারতের সভাপতিত্ব ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে কাউকে পিছনে না ফেলে সমগ্র বিশ্বকে একত্র করবে। ভারত গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠস্বর হিসাবে বিশ্বের ভাল করার কাজে ব্রতী হবে। বিশুদ্ধতা এবং স্থিতিস্থাপকতার প্রতীক পদ্ম এই আশার বাণীই তুলে ধরেছে যে, বিশ্ব সম্প্রদায় কোভিড-১৯ অতিমারির ক্ষয়কারী অর্থনৈতিক প্রভাবগুলি কাটিয়ে উঠবে।
ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব দেশের উদীয়মান প্রতিপত্তি ও উচ্চ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারের বলে বলীয়ান হয়ে ক্রমবর্ধমান আত্মবিশ্বাসের সুরে সুর মিলিয়েছে। তবুও এটিকে একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক মুহূর্তের সম্মুখীন হতে হবে, যখন এক দিকে ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে জি৭ দেশগুলি এবং রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনা এবং অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে। দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ভারতের প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা যথেষ্ট স্বীকৃত। অতিমারির শীর্ষে ভারত অন্যান্য চিকিৎসা সহায়তা ছাড়াও ১০১টি দেশকে ২৫০ মিলিয়ন টিকা প্রদান করেছে। প্রেসিডেন্ট পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর দেওয়া সাম্প্রতিক পরামর্শ হল যে, ‘এখন যুদ্ধের সময় নয়’। শান্তি ও অহিংসার নীতি বুদ্ধ ও গান্ধীর উত্তরাধিকারের মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হয়েছে।
ভারতের জি২০-র নেতৃত্ব ধারাবাহিকতা এবং পরিবর্তন দ্বারা সংজ্ঞায়িত হবে। উন্নয়নমূলক কর্মসূচির অগ্রাধিকার পাওয়া জরুরি। জ্বালানি বৈচিত্র্যকরণ এবং বাণিজ্য ও প্রযুক্তির উদীয়মান প্রতিবন্ধকতাগুলির মধ্যে ব্যবধান দূর করা প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন এবং ইউরোপের স্থবির অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করার আশঙ্কা জাগায়। সামষ্টিক অর্থনীতি এবং বাণিজ্যে নীতির সমন্বয় তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ আবশ্যিকতা। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে ‘গ্লোবাল সাপ্লাই চেন রেজিলিয়েন্স’ বৈঠকে মোদী বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলকে উন্নত করার জন্য — বিশ্বস্ত উৎস, স্বচ্ছতা এবং সময়সীমার মতো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহযোগিতার পক্ষে কথা বলেছেন। এই বছর এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে তিনি ইউক্রেন সঙ্কটের কারণে সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাতের উদাহরণ দর্শান এবং অভূতপূর্ব জ্বালানি ও খাদ্য সঙ্কটের কথা তুলে ধরেন।
ডিজিটাল রূপান্তরের প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতি একটি সুলভ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল গণ পরিকাঠামো তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রধান উপাদান হবে। ইউনিফাইড পেমেন্টস ইন্টারফেস (ইউপিআই), ডিরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার এবং কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিতে আধার প্রমাণীকরণের সঙ্গে দেশের অনুকরণীয় সাফল্য উন্নয়নশীল বিশ্বের কাছে দেশের ক্রমবর্ধমান প্রাসঙ্গিকতাকেই তুলে ধরে। কো-উইন মঞ্চের ব্যবহার টিকার লভ্যতা এবং সমতা বৃদ্ধি করেছে। ভারত টিকা উৎপাদনে ন্যায়সঙ্গত লভ্যতা সুনিশ্চিত করতে টিআরআইপিএস মকুবের জোরালো আবেদন জানায়।
সর্বত্র অর্থনীতিগুলি ডিজিটালকরণের দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ায় একটি ওপেন সোর্স, ওপেন অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই) এবং বেসরকারি ক্ষেত্রগুলির মুক্ত উদ্ভাবনের এক মঞ্চ হিসেবে সরকারি ডিজিটাল মঞ্চগুলির জন্য একটি আন্তঃপরিচালনযোগ্য পরিকাঠামোর উপর ঐকমত্য গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ। এটি নতুন তথ্য, পরিমাপ সরঞ্জাম, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সূচক এবং স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন-সহ বিশ্বব্যাপী জনকল্যাণের জন্য ডিজিটাল রূপান্তরের প্রভাবকে সর্বোৎকৃষ্ট করতে সহায়তা করবে। জলবায়ু প্রতিবন্ধকতা ভারতের সভাপতিত্বের জন্য অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে। দেশটির দূষণহীন শক্তি রূপান্তর এবং বৈশ্বিক জলবায়ু প্রশমন প্রচেষ্টা সর্বোচ্চ পর্যায়ে দেশটির নেতাদের দায়বদ্ধতাই প্রদর্শন করে। গ্লাসগোয় কপ২৬-এ মোদী মিশন লাইফ-এর প্রস্তাব করেন, যেটিতে ব্যক্তির আচরণকে বৈশ্বিক জলবায়ু কর্মসূচি আখ্যানের কেন্দ্রে স্থান দেওয়া হয়। মিশনটি প্রো-প্ল্যানেট পিপল (পি3) নামে পরিচিত ব্যক্তিদের একটি বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা ও লালনপালন করতে চায়, যারা পরিবেশবান্ধব জীবনধারা গ্রহণ ও প্রচার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটি এই ধারণার উপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছে যে, দায়িত্বশীল ব্যক্তির ব্যবহার প্রকৃতিতে সৃষ্ট ক্ষতিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে।
এই বছর যখন বৈশ্বিক জনসংখ্যা আট বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে, তখন আমাদের গান্ধীর সতর্কতাবাণীই মনে করতে হবে অর্থাৎ পৃথিবীতে প্রত্যেকের প্রয়োজন মেটানোর রসদ রয়েছে, কিন্তু সকলের লোভ নিরসনের জন্য নয়। কপ২৭-এ এবং জি২০-র সভাপতিত্বের সময় ভারতকে জলবায়ু অর্থায়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বিশেষ করে ২০২০ সাল থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন এবং প্রশমনে সহায়তা করার জন্য ইতিমধ্যেই উন্নত দেশগুলির প্রতিশ্রুত বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঊর্ধ্বে উঠে একটি নতুন পরিমাপযোগ্য লক্ষ্য স্থাপন করতে হবে। বিলম্বিত প্রতিশ্রুতিটি ভারতের সভাপতিত্ব চলাকালীন ২০২৩ সালে পূরণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং সেখান থেকে জি২০-র লক্ষ্য হবে, নিজেকে অন্য মাত্রায় উন্নীত করা।
কপ২৬-এ প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘পঞ্চামৃত’ ঘোষণা – ২০৭০ সালের মধ্যে শূন্য নিঃসরণ অর্জন, ২০৩০ সালের মধ্যে অজীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষমতা ৫০০ গিগাওয়াট করে তোলা, ২০৩০ সালের মধ্যে পুনর্নবীকরণযোগ্য বিকল্পগুলির মাধ্যমে জ্বালানির প্রয়োজনের ৫০ শতাংশ পূরণ, ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ১ বিলিয়ন টন হ্রাস এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতীয় অর্থনীতিতে কার্বনের তীব্রতার হার ৪৫ শতাংশ কমানো – ভারতকে জলবায়ু নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। জি২০ সভাপতিত্ব ভারতকে ইইউ, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে – বিশেষত সৌর, বায়ু এবং হাইড্রোজেনে – পরিচ্ছন্ন শক্তি অংশীদারিত্বের জন্য তার বেশ কয়েকটি উদ্যোগকে প্রেরণা জোগানোর সুযোগ করে দেবে। এটি ২০১৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্স-এ (আইএসএ) মোদীর দ্বারা প্রথম প্রস্তাবিত ‘এক সূর্য, এক বিশ্ব, এক গ্রিড’-এর ধারণাকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য একটি মঞ্চ প্রদান করবে।
দূষণহীন জ্বালানি এবং এসডিজি অর্জন পারস্পরিক ভাবে শক্তিশালী হতে পারে। দূষণহীন হাইড্রোজেন একটি শিল্প স্তরে জীবাশ্ম জ্বালানি প্রতিস্থাপন করতে পারে, যার মধ্যে শোধনাগার, সার, পরিবহণ এবং সিমেন্টের মতো প্রশমনে কঠিন ক্ষেত্রগুলিও রয়েছে। জি২০-র বৈশ্বিক শূন্য নিঃসরণ উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলিকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করার জন্য দ্রুত ও ডিকার্বনাইজড অর্থনৈতিক বৃদ্ধির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করার মাত্রা এবং ক্ষমতা… দুইই ভারতের রয়েছে। গ্রিন অ্যামোনিয়া এবং গ্রিন শিপিং-সহ জিএইচটু-তে উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক কাঠামোই হল মূল চাবিকাঠি। বিশ্বব্যাপী ব্যাটারি জোট-সহ, গুরুত্বপূর্ণ খনিজগুলির নির্ভরযোগ্য সরবরাহ এবং শক্তি সঞ্চয়ের জন্য প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সহায়ক হতে পারে। জ্বালানি বাজারের অস্থিরতার কারণে ইউরোপে অসামরিক পারমাণবিক শক্তির জন্য নবজাত সমর্থনের নিরিখে জি২০ ছোট মডিউলার চুল্লি-সহ একটি প্রসারিত এবং শক্তিশালী অসামরিক পারমাণবিক শক্তি সহযোগিতা পরিকাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করতে পারে।
বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে বর্তমানে অপ্রতিনিধিত্বকারী, অকার্যকর বা আরও খারাপ… উভয় বলেই বিবেচনা করা হয়। স্থিতিশীল দূষণহীন রূপান্তরের জন্য পর্যাপ্ত ঋণের বর্ধিতকরণ এবং মিশ্রিত অর্থায়ন সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে একটি নতুন বহুপাক্ষিকতাবাদ এবং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়নের আহ্বান আসলে একটি জনপ্রিয় বৈশ্বিক অনুভূতিকেই প্রতিফলিত করে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতের বৈশ্বিক উদ্যোগ যেমন সাগর (সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রোথ ফর অল ইন দ্য রিজিয়ন), ‘নীল অর্থনীতি’, ‘পরিচ্ছন্ন মহাসাগর’ এবং দুর্যোগ-প্রতিরোধী পরিকাঠামোর মতো বিষয়গুলি জি২০-তে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
ভারতের সভাপতিত্বে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচনী ক্ষেত্র বা পরিসরগুলির প্রতিনিধিত্ব করা উচিত। আক্ষরিক অর্থেই এটি আন্তঃদক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক সমন্বয়কেও এগিয়ে নিতে পারে, যা ভারতের উত্থানের জন্য অপরিহার্য।
এটি বাস্তবেই ভারতের জন্য সেই মুহূর্ত, যেখানে সে বাণিজ্যবাদ, অতিমারি, যুদ্ধ এবং মতাদর্শগত বিপর্যয়ের ঊর্ধ্বে উঠে একটি মূল্যবোধ-ভিত্তিক ভবিষ্যতের দিকে বিশ্বকে চালিত করতে এবং এক নতুন আশার সঞ্চার করতে পারবে।
লেখক ভারতের জি২০ সভাপতিত্বের থিঙ্ক ২০ কোর গ্রুপের চেয়ার; তিনি মনোহর পারিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের মহাপরিচালক; প্রকাশিত মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।