নীল অর্থনীতি: স্থিতিশীল বৃদ্ধির আশ্রয়

জলবায়ু–ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সহ জলজ খাদ্যব্যবস্থা রক্ষা করার জন্য সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ অদূর ভবিষ্যতে নেট–শূন্য অবস্থা তৈরিতে সাহায্য করতে পারে

ভূমিকা

উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র (এসআইডি–জ) ও উপকূলীয় শহরগুলির চেয়ে আর কোথাও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলি বেশি তীব্রভাবে অনুভূত হয় না৷ বিশ্বের জনসংখ্যার এক–দশমাংশের বাসস্থল এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ মিটার উচ্চতার মধ্যে অবস্থিত এই অঞ্চলগুলি তাদের সাংস্কৃতিক ও ভৌত সম্পদ–সহ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও অম্লকরণের মতো সমুদ্রভিত্তিক ঝুঁকি সংমিশ্রিত জলবায়ুচালিত ধাক্কায় অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত হয়।

সেশেলস প্রজাতন্ত্র জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবগুলির সঙ্গে অপরিচিত নয়।‌ দেশটি সামুদ্রিক ও উপকূলীয় জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় প্রত্যক্ষ করেছে, যা পরবর্তীতে এর খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা, মৎস্যসম্পদ ও পর্যটন ক্ষেত্রের স্থিতিস্থাপকতাকেও প্রভাবিত করেছে। প্রতিক্রিয়া হিসাবে দ্বীপরাষ্ট্রটি ২০১৮ সালে তার নীল অর্থনীতি (বিই) মডেল চালু করে। এটি তার সমুদ্র সম্পদের স্থিতিশীল ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে। মডেলটি স্থানীয় জনসম্প্রদায়, অর্থনীতি ও সংরক্ষণ প্রচেষ্টার উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য বিকল্প অর্থায়ন–প্রবাহ সরবরাহ করে।

সেশেলস ছিল বিশ্বের প্রথম দেশ যেটি ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্লু বন্ড ইস্যু করে, এবং চালু করে ডেট–টু–অ্যাডাপটেশন সোয়াপ, যেখানে বিই–তে বিনিয়োগের অনুকূলে ২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক ঋণ মকুব করা হয়েছে। অধিকন্তু, দেশটি ২০২০ সালে তার এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোন (ইইজেড)–এর ৩০ শতাংশকে সামুদ্রিক সুরক্ষিত এলাকা (মেরিন প্রোটেকটেড এরিয়া বা এমপিএ) হিসাবে ঘোষণা করেছে, এবং এইভাবে এসডিজি ১৪.‌৫–এর আওতায় দেওয়া নিজের প্রতিশ্রুতি অতিক্রম করেছে।

ভারত দীর্ঘদিন ধরে সেশেলসের বিই যাত্রায় সহায়ক অংশীদার এবং বর্তমানে তার নিজস্ব জাতীয় বিই নীতি চূড়ান্ত করছে। ১.৪ বিলিয়ন শক্তির দেশটির জি২০–র সভাপতিত্ব গ্রহণের পর জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধানের জন্য ফোরামের প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া উচিত সমুদ্রভিত্তিক বিনিয়োগগুলি, যা নীতি–নির্ধারণের পর্যায়টি ছাপিয়ে ব্যক্তি–পর্যায়ে সমাজকে রূপান্তরিত করতে চায়৷

ফোকাস এলাকা

সেশেলস বিই বিভিন্ন চিরাচরিত ক্ষেত্র, যেমন মৎস্য, পর্যটন, তেল ও গ্যাস, এবং সেইসঙ্গে জলজ চাষ, নীল কার্বন, সামুদ্রিক জৈবপ্রযুক্তির মতো বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট কিছু নতুন ক্ষেত্র নিয়ে গঠিত। পুরনো ক্ষেত্রগুলোতে স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানোর জন্য প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে কাজে লাগানো, এবং নতুনের ক্ষেত্রে প্রাণবন্ততা নিশ্চিত করার জন্য মূল মানব সম্পদের পুনর্দক্ষতায়ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। যেমন, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা হ্রাস এবং স্থিতিশীল খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশটির জলজ চাষের ক্ষেত্রের দ্রুত বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। এমন একটি বিশ্বে যেখানে তিন বিলিয়নেরও বেশি মানুষের স্বাস্থ্যকর খাদ্যের সুযোগ নেই, জলজ চাষে স্থিতিশীল মৎস্য উন্নয়ন অপুষ্টির অবসান ঘটাতে পারে এবং প্রকৃতি–ইতিবাচক খাদ্য শৃঙ্খল তৈরি করতে পারে।

বিশ্বের উপকূলরেখার প্রায় ৪৫ শতাংশ জি২০ দেশগুলিতে আছে। প্রাসঙ্গিকভাবে, ভারতের জনসংখ্যার প্রায় এক–ষষ্ঠাংশ উপকূল বরাবর বাস করেন। এই জনসম্প্রদায়গুলি উপকূলীয় ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের উপর নির্ভর করেন যা জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, রোগ নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য নিরাপত্তা থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক জীবিকা পর্যন্ত নানা ধরনের পরিষেবা প্রদান করে। যাই হোক, বিশ্বজুড়ে এবং বিশেষ করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র অতিশোষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিপদের সম্মুখীন প্রাকৃতিক সম্পদগুলির মধ্যে পড়ে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বিশ্বের যুদ্ধে এই ব্যবস্থাগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা যে মূল পরিষেবা প্রদান করে তা হল তাদের স্থলজগতের তুলনায় প্রায় পাঁচগুণ কার্বন ডাইঅক্সাইড বিচ্ছিন্ন করার ক্ষমতা। লবণাক্ত জল, ম্যানগ্রোভ অরণ্য ও সাগর–ঘাসের তৃণভূমির মতো বাস্তুতন্ত্রগুলি, যেগুলি সাধারণত ব্লু কার্বন সিঙ্ক নামে পরিচিত, সেগুলি গ্রিনহাউস গ্যাস (জিএইচজি) নির্গমন কমাতে কার্যকর প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান প্রদান করতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে, সেশেলস এগুলিই বিবেচনা করছে। তার হালনাগাদ করা জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (‌‌ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস বা এনজিসি’‌স)–এ দেশটি ২০২৫ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ সাগর–ঘাস ও  ম্যানগ্রোভ অরণ্য  রক্ষা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ফলস্বরূপ, দ্বীপরাষ্ট্রটি ২০৩০ সালের মধ্যে তার জিএইচজি নির্গমন ২৬.৪ শতাংশ হ্রাস করবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে নেট শূন্যয় পৌঁছবে বলে আশা করছে।

বিশ্বের বৃহত্তম সাগর–ঘাসের তৃণভূমিগুলির একটি হিসাবে সেশেলস বর্তমানে ব্লু কার্বন সিঙ্কের মানচিত্র তৈরি করছে, এবং এটি রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে তার স্টক রিপোর্ট–করা  প্রথম দেশ হতে পারে। আশা করা যায় যে এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে সরকার ব্লু কার্বন সিঙ্কগুলি কীভাবে বিশ্ব উষ্ণায়নকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করে প্যারিস চুক্তির অবদানগুলি পূরণ করতে সাহায্য করছে, তা প্রদর্শন করতে পারে। সেইসঙ্গে এভাবে নীল কার্বন বাজার বিকাশের জন্য একটি কার্যকর নীতি কৌশলও সংজ্ঞায়িত হতে পারে৷ নিজের কার্বন স্টক–এর প্রকৃত অনুধাবনের ফলে সেশেলস ভবিষ্যতে নিজেদের কার্বন নির্গমন অফসেট করতে ইচ্ছুক দেশগুলির সঙ্গে ব্যবসা করতে পারে।

পরবর্তী পদক্ষেপ

সেশেলস তার বিই যাত্রার শুরু থেকেই সহযোগী নেটওয়ার্কগুলির মধ্যে সর্বোত্তম অনুশীলনগুলি ভাগ করে নেওয়ার একটি নীতি অনুসরণ করেছে৷ বর্তমানে দ্বীপরাষ্ট্রটি ব্লু ওয়াল উদ্যোগের অংশ, যা একটি পশ্চিম ভারত মহাসাগর–নেতৃত্বাধীন, আফ্রিকা–চালিত পরিকল্পনা। এর লক্ষ্য হল সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ এবং স্থিতিশীলভাবে সম্পদ ব্যবহার করা, এবং তার পাশাপাশি আর্থ–সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে পারস্পরিক উপযোগিতার (‌সিমবাওটিক)‌ সম্পর্ক বজায় রাখা। জি২০–র সভাপতি হিসাবে ভারত সহযোগিতা ও অন্তর্ভুক্তির নিজস্ব মূল নীতিগুলি বজায় রাখার উপর জোর দিয়েছে, যা আফ্রিকান ইউনিয়নকে ফোরামের স্থায়ী সদস্য করার জন্য আহ্বানের প্রতি সমর্থন পর্যন্ত প্রসারিত হওয়া উচিত। এই ধরনের একটি পদ্ধতি দেশগুলিকে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনায় সম্মত করতে ফলপ্রসূ হতে পারে যা নীল বৃদ্ধির বিকাশকে উৎসাহিত করবে।

এই মুহূর্তে এই ধরনের পরিকল্পনার প্রয়োজন খুব বেশি, কারণ জলবায়ু পরিবর্তন রোধ বা সীমাবদ্ধ করার ক্ষমতা বহন করে এমন জলজ বাস্তুতন্ত্র চরম অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে। তাদের জলবায়ু কর্মনীতির অংশ হিসাবে জি২০ দেশগুলির জরুরি জলবায়ু–ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উদ্যোগ বিবেচনা করা উচিত, এবং জলজ খাদ্য ব্যবস্থাকে ঝুঁকিমুক্ত করার চেষ্টা করা উচিত। জলবায়ু–ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সহ জলজ খাদ্যব্যবস্থা রক্ষায় সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ অদূর ভবিষ্যতে নেট–শূন্য অবস্থা তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ প্রতিরোধে মহাসাগরগুলি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তার পরিপ্রেক্ষিতে জি২০–কে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ও এসআইডিএস–এর সমস্ত স্তরে স্থিতিস্থাপক পরিকল্পনার প্রয়োজনের উপর জোর দিতে হবে। বিকল্প নীল অর্থায়নের উৎসগুলির, যেগুলি দুর্যোগ থেকে পুনরুদ্ধারের পথের বর্তমান সংস্থানগুলি (যেমন অনুদান, বন্ড, সরকারি–বেসরকারি বিনিয়োগ, বিমা বা জনহিতকর উপায়)‌ অন্যত্র সরিয়ে দেওয়াকে বাধা দেয় বা হ্রাস করে, সেগুলির অনুসন্ধান করা উচিত। জি২০ সেই লক্ষ্যে নীল অর্থনীতির ক্ষেত্রগুলির উন্নয়নে এবং স্থিতিশীল পর্যটন পরিকাঠামো, বন্দর উন্নয়ন বা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমে বৃহত্তর স্থিতিস্থাপকতা তৈরিতে অর্থ–অভিযোজন উদ্দেশ্যগুলিকে একীভূত করার দিকেও নজর দিতে পারে।

সব শেষে, জি২০–র উচিত সেই প্রকৃতি–ইতিবাচক নীতির প্রতি অঙ্গীকার করা যা মানুষ–কেন্দ্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং শুধু বিই পরিসরে সীমাবদ্ধ। দীর্ঘমেয়াদি নীতি পরিকল্পনা,‌ যা দুর্বলতা হ্রাস করতে এবং ব্যক্তির অর্থনৈতিক কার্যকলাপ, বাড়িঘর ও পরিকাঠামো উন্নয়নে পরিবর্তন আনতে চায়, তা বাস্তবায়নের সময় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জটিলতাগুলিকে উপেক্ষা করা যায় না।

উপসংহার

স্থিতিশীল সমুদ্র–সমাধানে বিনিয়োগ করা প্রতিটি ডলার এই গ্রহের জন্য আনুমানিক পাঁচ ডলারের সুবিধা প্রদান করে। বিই পরিসরে নতুন করে মনোযোগ দেওয়া হলে তা স্থিতিশীল বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ভবিষ্যৎ জলবায়ু–প্ররোচিত ধাক্কা প্রশমনের জন্য যে সব সুযোগ আছে তা ব্যবহার করতে পারে৷ জি২০ নীল অর্থনীতির জন্য এমন একটি ন্যায্য নিয়ন্ত্রক পরিবেশ তৈরি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারে যা সঠিক প্রণোদনা  বহন করে, ন্যায্য আর্থ–সামাজিক ফলাফল নিয়ে আসে, এবং ঝুঁকি–হ্রাস ব্যবস্থা তৈরি করে। এমনটি করা হলে তার ফলে স্থিতিস্থাপকতা নির্মাণের উদ্যোগে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার মতো জলবায়ু অভিযোজন নীতি প্রাধান্য পাবে। এই পদ্ধতির জন্য অর্থনৈতিক যুক্তির বাইরে বেরিয়ে এই ধরনের বিনিয়োগগুলিকে ভবিষ্যৎ–সুরক্ষা প্রচেষ্টা হিসাবেও বিবেচনা করা যেতে পারে, যা বিশ্বজুড়ে সমাজ ও ব্যক্তিদের উপকার করবে।


এই নিবন্ধটি G20-Think20 Task Force 3: LiFE, Resilience, and Values for Wellbeing   সিরিজের একটি অংশ