গত কয়েক দশক যাবৎ বিশ্বায়ন সমগ্র পৃথিবীকে বৃদ্ধি ও আধুনিকীকরণের দিকে চালিত করার একমাত্র বাহক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। জাতীয় সীমানা ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামোগুলিকে সাযুজ্যপূর্ণ দেখার প্রত্যাশা ছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কোভিড-১৯ অতিমারি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে বাণিজ্য-যুদ্ধের মতো বিভিন্ন সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং অবিশ্বায়নের ঘটনার পুনরাবৃত্তির পরে বৈশ্বিক সমাজ এই প্রবণতা সম্পর্কে আরও বেশি সতর্ক হয়ে উঠেছে।
অতীতে বহু উন্নয়নশীল দেশ – যারা এই বৈশ্বিক প্রবণতাকে সমাদর করেছিল – তারা দেখেছিল যে, বিশ্বায়ন একটি দ্বিমুখী তরবারি। বহু উন্নয়নশীল দেশ বিশ্বায়নের শক্তিকে প্রতিরোধ করতে পারেনি এবং শেষ পর্যন্ত তাদের অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। এ ছাড়াও, চিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য-যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী অতিমারি এবং ইউরোপে রাজনৈতিক চাপানউতোরের মতো সাম্প্রতিক ঝুঁকি পরিলক্ষিত হয়েছে। বহু দেশ দীর্ঘায়িত সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন, খাদ্য ও জ্বালানির আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি এবং জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মতো বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে। এ ছাড়াও, কোভিড অতিমারি চলাকালীন অনেক দেশের কাছেই এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, অন্যান্য দেশ অথবা বৃহৎ শক্তির উপর সাহায্যের জন্য ভরসা করার উচ্চ মূল্য চোকাতে হয় ও এর সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনও জড়িত। সুতরাং ‘অবিশ্বায়ন’ নামক প্রক্রিয়ার ফলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সমন্বয় কমে এসেছে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ কমেছে। এই প্রবণতা ২০০৮ সালে হ্যামবার্গার সঙ্কটের মাধ্যমে আবির্ভূত হলেও কিন্তু বিশ্বব্যাপী অতিমারির পরে তা স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। ডব্লিউটিও একটি বিবৃতিতে জানায় যে, ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পতনের পরিমাণ বিশ্বব্যাপী জিডিপি হ্রাসের চেয়ে বেশি। একই বছরে ফেস মাস্ক এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম রফতানি নিষেধাজ্ঞার মতো বেশ কিছু বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা লাগু করা হয়। অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী বেশ কয়েকটি দেশ সম্প্রতি তাদের নাগরিকদের দাবি অনুযায়ী মুক্ত বাণিজ্যের চেয়ে অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বের উপর বেশি জোর দিয়েছে।
কিছু ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বিশ্বায়নের সুবিধাগুলি তার ঝুঁকিকে ছাপিয়ে যেতে পারে, যদি দেশগুলি তা সঠিকভাবে গ্রহণ করে। বিশ্বায়নের ধারণা ভারতীয় সভাপতিত্বের অধীনে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর বর্তমান জি২০-র ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যার অর্থ হল সমগ্র বিশ্ব আদতে একটিই পরিবার। তবে এটি আবশ্যক যে, দেশগুলির স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানোর জন্য এবং আন্তর্জাতিক ঝুঁকিগুলি প্রশমন করার উদ্দেশ্যে এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত যা দেশগুলিকে বিশ্বায়নের প্রবাহে বিকশিত হতে সাহায্য করবে। এই ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য একটি মডেল হল সাফিসিয়েন্সি ইকোনমি বা পর্যাপ্ততার অর্থনীতি। এই ভাবনাটি একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মূলত নাগরিকদের কল্যাণ এবং মধ্যপন্থার উপরে জোর দেয়।
দুঃখজনক ভাবে ১৯৯৭ সালে এশীয় আর্থিক সঙ্কট তাইল্যান্ডের দশকব্যাপী অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক উত্থানের সমাপ্তি ঘটায়। দেশটি এই অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে এবং স্বীকৃতি দিয়েছে যে, গত এক দশকের উন্নয়ন অত্যধিক অর্থনৈতিক প্রসারের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধির উপর খুব বেশি জোর দিয়েছে। দেশটি অতি-ব্যবহার এবং অতিরিক্ত বিনিয়োগে লিপ্ত হয়ে সংযমকে স্পষ্টতই উপেক্ষা করেছে, যা সঞ্চয়ের পরিমাণ হ্রাস করেছে এবং বৈদেশিক ঋণের উপর তার নির্ভরতা বাড়িয়েছে। তাই তাইল্যান্ড, অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধের উপর তার নির্ভরতা বৃদ্ধি করে এবং অত্যধিক বৃদ্ধির পরিবর্তে সুসংহত স্থিতিশীল উন্নয়নের প্রচারের মাধ্যমে তার গতিপথ পুনর্বিবেচনা ও পরিবর্তন করতে শুরু করেছে।
রাজা ভূমিবল ১৯৯৭ সালের ৪ ডিসেম্বর তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘অর্থনৈতিক বাঘ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হল আমাদের খাওয়ার জন্য এবং বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ আছে কি না। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি আমাদের তা প্রদান করবে। এটি আমাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।’
তাইল্যান্ডের রাজা ভূমিবল এবং বেশ কয়েকজন তাই অর্থনীতিবিদ দ্রুত বৈশ্বিক পরিবর্তনের মোকাবিলা করার জন্য সমাধান হিসেবে পর্যাপ্ততার অর্থনীতির কথা উল্লেখ করেছেন। দর্শনটিকে ব্যবহার করে বর্তমান অপ্রতিসম উন্নয়নের সমস্যার মোকাবিলা করা যেতে পারে। পর্যাপ্ততার অর্থনীতি প্রচলিত অর্থনীতির তত্ত্বের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়, যেহেতু এটিতে প্রধানত বাণিজ্য এবং বিশ্বায়নের উপর জোর দেওয়া হয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে এটি বৃদ্ধির একটি ধারণা গ্রহণ করে। তাইল্যান্ডে ১৯৯৭ সালের সঙ্কটের কারণ কী তা খুঁজে বের করতে এবং ভবিষ্যতের জন্য আরও উপযুক্ত নীতি তৈরি করার জন্য পর্যাপ্ততার অর্থনীতি অপরিহার্য।
অর্থনীতিবিদরা পর্যাপ্ত বিশ্লেষণ না করে প্রায়শই সম্পদ এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারণাগুলি ব্যবহার করেন। বর্ধিত সম্পদকে সাধারণত একটি ইতিবাচক প্রবণতা হিসাবে দেখা হয় কারণ এটি মানুষ এবং দেশকে আরও উন্নত জীবনযাপন করতে সাহায্য করে। উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং একটি বৃহত্তর মানব সম্পদ ভিত্তির সমন্বয় বস্তুগত প্রাচুর্যের দ্বারাই সম্ভব। তাই এটি সাধারণত বিশ্বাস করা হয় যে, সম্পদ মঙ্গল বৃদ্ধি করে। সম্পদ অর্জনের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি কল্যাণসাধন বৃদ্ধির লক্ষ্যকেও মুষ্টিমেয় কয়েকজনের প্রাচুর্য অর্জনের পথ হিসেবে ভুল ব্যাখ্যা করা হতে পারে।
সম্পদ নিশ্চিতভাবেই ভাল থাকার সমার্থক নয়, আনন্দ তো বহু দূরের বিষয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সম্পদ সৃষ্টির উপর অতিরিক্ত জোর দেওয়া উচিত নয়। রিচার্ড ইস্টারলিনের বক্তব্য অনুযায়ী, মৌলিক প্রয়োজনীয়তাগুলি পূরণ হওয়ার পরে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ সুখের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে পারে না। তাই চরম অসাম্যের সমাজে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং বর্ধিত আয়ের আকাঙ্ক্ষা সমাজের সদস্যদের মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং হিংসাকে প্ররোচনা জোগায়।
পর্যাপ্ততার অর্থনীতি সম্পদের তুলনায় সুখের উপর বেশি জোর দেয়। এটি মানুষকে অর্থ বা সম্পদ অর্জনের জন্য বাজার অর্থনীতি ব্যবহার করতে বাধা দেয় না। বাস্তব প্রয়োজনসম্পন্ন মানুষদের মধ্যে পুনর্বণ্টনের জন্য ব্যবস্থাটির কাছে আরও বেশি সম্পদ এবং পুঁজির সংস্থান অর্জন করতে এটি কেবলমাত্র ব্যক্তিদের তাদের দাবি সংযত করতে এবং অতিরিক্ত সম্পদ এবং পুঁজি মজুত না করার কথা বলে।
পর্যাপ্ততার অর্থনীতিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসাবে ভুল ব্যাখ্যা করা উচিত নয়, সরাসরি বিশ্বায়নের ধারার বিপরীতে এগোনো বা অত্যন্ত বিনয়ী জীবনের মরীচিকার দিকে পশ্চাদপসরণ করাও উচিত নয়। বরং এটি বিশ্বায়নের অনিশ্চয়তা মোকাবিলার একটি উপায়ের কথা বলে এবং ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ লক্ষ্য অর্জনের পথ করে দেয়। পর্যাপ্ততার অর্থনীতি বাজার অর্থনীতি এবং বিশ্বায়নের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ব্যক্তি এবং দেশ উভয়ের পক্ষ থেকে একটি নির্দিষ্ট স্তরের স্বনির্ভরতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়। এই প্রসঙ্গে পর্যাপ্ততার অর্থ হল ‘খুব স্বল্প নয়’ এবং ‘খুব বেশিও নয়।’ মাঝামাঝি পন্থা বা মধ্যপন্থা অভ্যন্তরীণ সম্পদ এবং বাহ্যিক চাহিদা, তৃণমূল স্তরে সমাজের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা এবং বিশ্বায়িত বিশ্বের অনিবার্য পরিণতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একটি দাঁড়িপাল্লা হিসাবে কাজ করতে পারে।
১৯৯৮ সালের ৪ ডিসেম্বর রাজা ভূমিবল বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘পর্যাপ্ততা হল আধিক্যহীনতা। যদি কেউ নিজের ইচ্ছায় মধ্যপন্থী হন, তা হলে তাঁর লোভ কম হবে। যদি কারও লোভ কম হয়, তবে সে অন্যদের কম সুযোগ নেবে। যদি সকল দেশই নিজের ইচ্ছায় চরম বা অতৃপ্ত না হয়ে এই ধারণাটিকে ধরে রাখে… তা হলে পৃথিবী একটি সুখকর জায়গা হয়ে উঠবে।’
বিদেশি শক্তির মধ্যে বাণিজ্যিক যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক অতিমারি থেকে বিশ্বায়নের ফলে দরিদ্রদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। বর্তমান সমস্যাটি অপ্রতুল অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে উদ্ভূত সম্পদের অভাবজনিত নয়, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নের দার্শনিক মতাদর্শ সংক্রান্ত, যেটিতে সমাজের মানুষের সাধারণ কল্যাণের পরিবর্তে সম্পদ সৃষ্টির উপরে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশগুলি একে অন্যের উপরে আস্থা হারিয়েছে যা পৃথিবীকে অ-বিশ্বায়নের দিকে চালিত করেছে। এর একমাত্র সমাধান হল সেই দর্শনকে আঁকড়ে ধরা, যা সকল দেশকে বিশ্বায়িত পৃথিবীর বাহ্যিক ধাক্কা থেকে সুরক্ষা জোগাবে। কারণ দিনের শেষে সম্পদ এবং কল্যাণের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে সংযম বজায় রাখার জন্য একটি পর্যাপ্ততার অর্থনীতির ধারণা ব্যবহার করে একটি উন্নত উন্নয়ন মডেল তৈরি করা যেতে পারে। এটি কেবল সমস্যার সমাধানই করবে না, এটি বিশ্বায়নকে আঁকড়ে ধরতে সাহায্য করবে এবং ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ অর্জনের পথ খুলে দেবে।
এই প্রতিবেদনটি ‘জি২০-থিঙ্ক২০ টাস্ক ফোর্স ৩: লাইফ, রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড ভ্যালুজ ফর ওয়েলবিয়িং’ সিরিজের অন্তর্গত।