সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ বছরের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া জি২০-তে ভারতের সভাপতিত্বের জন্য প্রতীক, ভাবনা এবং ওয়েবসাইটের উন্মোচন করেন। প্রতীকটিতে পদ্মফুলের স্থান সম্পর্কে গর্ব প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘(এটি) এই সময়ে আশার প্রতিনিধিত্ব করে। পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক না কেন, পদ্ম ফোটে।’ প্রকৃত পক্ষে ভারত সমসাময়িক ইতিহাসের পরিবর্তনের এক সূচনাবিন্দুতে জি২০-এর হাল ধরছে, যে কারণে ‘প্রতিকূল’ শব্দটি বিশ্বব্যবস্থার অবস্থা বর্ণনা করার নিরিখে যথার্থ বলে মনে হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদী আরও বলেন, ‘ভারত এমন এক সময়ে জি২০ সভাপতিত্ব করতে চলেছে যখন সমগ্র বিশ্ব এক সঙ্কট এবং বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলেছে। বিশ্ব শত বর্ষে এক বার ঘটা বিপর্যয়কর অতিমারি, সংঘাত এবং বিপুল অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে।’
২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব চলাকালীন ভারতের লক্ষ্য হল সারা দেশে একাধিক স্থানে ৩২টি বিভিন্ন ক্ষেত্রসংশ্লিষ্ট ২০০টিরও বেশি সমাবেশ আয়োজন করার মাধ্যমে বিগত ৭৫ বছরে ভারতের উন্নয়নের যাত্রাকে তুলে ধরা। ভারত নিয়ম নির্ধারণকারী ও ফলাফলকে রূপদানকারী একটি ‘নেতৃস্থানীয় শক্তি’-র ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী এবং এই সভাপতিত্ব ভারতের ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগের একেবারে যথার্থ সময়ে এসে উপস্থিত হয়েছে।
বিশ্ব জুড়ে টালমাটাল পরিস্থিতি অব্যাহত এবং প্রতিবন্ধকতাও প্রচুর: কোভিড-১৯ অতিমারি, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত, মার্কিন-চিন বিরোধ এবং বহুপাক্ষিক শৃঙ্খলার বিলুপ্তি গোটা বিশ্বকে অভূতপূর্ব ভাবে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। গত তিন দশকে যেসব ধারণার ভিত্তিতে আমরা এগিয়েছি, তার অনেকগুলিই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ঠান্ডা লড়াই-পরবর্তী বিশ্ব-সহ সমগ্র ‘ইতিহাস’-এই আমরা দেখেছি, কোনও কিছু আক্ষরিক অর্থে শেষ হয় না। ক্ষমতার ভারসাম্যে চ্যুতি, প্রযুক্তির জোরে শীর্ষে পৌঁছনোর চেষ্টা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষয়ের ফলে হওয়া মৌলিক রূপান্তরের সঙ্গে বিশ্ব লড়ছে। এই অন্তর্নিহিত পরিবর্তনগুলি কোভিড-১৯ অতিমারি এবং ইউক্রেনে সংঘাতের কারণে তীব্রতর হয়েছে, যার ফলে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির চাপ, খাদ্য ও শক্তির সঙ্কট এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। দেশগুলি তাদের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদার জোগান দিতে নিজেদের কোষাগার উজাড় করে দিচ্ছে এবং আমরা স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি।
এই বৈশ্বিক ভাঙনের সময়ে এবং যখন পৃথিবীর অস্তিত্বই একটি ব্যাপক জলবায়ু সঙ্কটের সামনে অরক্ষিত, তখন জি২০-র মতো মঞ্চই একমাত্র আংশিক মাত্রায় হলেও বৈধতার দাবি রাখে। জি২০ সমসাময়িক প্রতিবন্ধকতাগুলি থেকে বিশ্বকে মুক্তি দেবে, এ আশা দুরাশা হলেও, এর সদস্য দেশগুলি বিশ্বের জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশের জন্য দায়বদ্ধ এবং তারা বিশ্বব্যাপী জিডিপি-র ৮৫ শতাংশ এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ জুড়ে রয়েছে। সুতরাং কার্যকর বহুপাক্ষিকতাবাদে আমাদের বিশ্বাসকে পুনর্বহাল করার সম্ভাবনা এটির রয়েছে। এবং এই সুদীর্ঘ কাজটির জন্য এমন এক ধরনের নেতৃত্বের প্রয়োজন, যা প্রদান করার মতো ক্ষমতা শুধু মাত্র ভারতেরই রয়েছে।
জি২০ এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে যে কারণে অনন্য হয়ে উঠেছে, তা হল বৈশ্বিক প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জগুলি সম্পর্কে আলোচনা ও তার সমাধান খুঁজে বের করার কাজে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিকে একত্র করা। গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে তোলার মাধ্যমে ভারত কার্যকর ভাবে এই বিভাজন দূর করতে পারে। নয়াদিল্লি গ্লোবাল সাউথের আকাঙ্ক্ষার পক্ষে আওয়াজ তুলেছে এমন এক সময়ে যখন কয়েকটি বৈশ্বিক শক্তির কাছে দুর্বলতমদের প্রয়োজন মেটানোর মতো সময় বা সম্পদ কোনওটাই নেই এবং তারা তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটাতে ব্যস্ত। বৈশ্বিক ব্যাঘাতের চাপ সবচেয়ে বেশি বহন করেছে দরিদ্রতর অর্থনীতি এবং খুব কম সংখ্যক দেশই এই প্রতিবন্ধকতাগুলিকে তাদের যথাযোগ্য গুরুত্ব দিতে আগ্রহী। সাম্প্রতিক কালে ভারত ইউনাইটেড নেশনস সিকিউরিটি কাউন্সিল, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো একাধিক বৈশ্বিক মঞ্চে তাদের উদ্বেগগুলি আরও জোরদার ভাবে তুলে ধরেছে।
জি২০ সভাপতিত্বের জন্য ভারত নিম্নলিখিত ক্ষেত্রগুলিতে মনোযোগ দিতে প্রস্তুত: ‘নারীর ক্ষমতায়ন, ডিজিটাল সরকারি পরিকাঠামো, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পর্যটন, জলবায়ু অর্থায়ন, চক্রাকার অর্থনীতি, বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা, শক্তি নিরাপত্তা, সবুজ হাইড্রোজেন, বিপর্যয়ের ঝুঁকির প্রশমন ও স্থিতিস্থাপকতা, অর্থনৈতিক অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই এবং বহুপাক্ষিক সংস্কার।’ জি২০ প্রাথমিক ভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও আর্থিক চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করার জন্য গঠিত হলেও এর দায়িত্ব বেড়েছে এবং ভূ-রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতির বর্তমান সংমিশ্রণে, বৈশ্বিক প্রশাসনিক আলোচনায় গোষ্ঠীটির কেন্দ্রিকতা বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। নয়াদিল্লি দীর্ঘ দিন ধরে এ ব্যাপারে জোর দিয়ে আসছে যে, বিশ্বকে বিশ্বায়নের বিষয়ে তার আলোচনাগুলিকে সন্ত্রাসবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অতিমারির মতো সামাজিক ও মানবিক বিষয়-সহ প্রকৃত অগ্রগতি ও স্থিতিশীল উন্নয়নের বিরোধী আর্থিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতাগুলি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ‘পুনরায় সংজ্ঞায়িত’ করতে হবে।
ভারতের জি২০ সভাপতিত্বের লক্ষ্য হবে মেরুকরণ থেকে বিশ্বকে বৃহত্তর সংহতির দিকে নিয়ে যাওয়া। একটি বহুসাংস্কৃতিক গণতন্ত্র হওয়ার নিজস্ব বাস্তবতা এটিকে বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় অংশীদারদের একত্র করতে হবে এবং কাজ করার জন্য সঠিক দিশা দেখাতে হবে। ভারতের ২০২৩ সালের জি২০-র মূল সুর হল— বসুধৈব কুটুম্বকম: এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ— যা বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে ভারতের ধারণা এবং সেই প্রেক্ষিতে তার নিজস্ব ভূমিকাকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর পাশাপাশি নয়াদিল্লি এ-ও দর্শিয়েছে যে, সে কেবল বাগাড়ম্বরেই সীমিত থাকতে চায় না। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রথম বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন উন্নত দেশগুলি নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মনোনিবেশ করেছিল এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্কের জন্য প্রয়োজনের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি টিকা মজুত করে রেখেছিল, তখন ভারত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একজোটে কাজ করা এবং ন্যূনতম সংস্থান নিয়ে যারা কাজ করছে তাদের সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিল।
বৈশ্বিক ব্যবস্থায় এই বিদ্যমান সঙ্কটের মধ্যে ভারত একই প্রতিবন্ধকতাগুলির অন্তর্নিহিত সুযোগগুলিকে কাজে লাগাতে পারে। এক তীব্র আপৎকালীন সময়ে সর্বকালের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক সমাবেশগুলির একটির উপস্থাপক হয়ে নয়াদিল্লি তার বৃহৎ ভাবনা এবং বৃহৎ সক্ষমতা সংক্রান্ত প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিয়েছে, যেমনটা সারা বিশ্ব দীর্ঘ সময়ব্যাপী ভারতের কাছ থেকে আশা করে এসেছে।
নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে, সামনের পথ কঠিন। বিশ্বব্যাপী প্রশাসনিক ঘাটতির সমাধানের জন্য জি২০ কোনও বিশল্যকরণী নয় এবং তার সীমাবদ্ধতাও তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু ভারতের কার্যকর নেতৃত্বের সুবাদে বিগত বছরগুলিতে যে অবনতি হয়েছে, সেই বহুপাক্ষিক শৃঙ্খলাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ হতে পারে। ‘সংস্কারকৃত বহুপাক্ষিকতাবাদ’-এর জন্য ভারতের তৎপরতা জি২০-এর কার্যকর নেতৃত্বপ্রদানকে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। বর্তমানে ভারত তার বৈশ্বিক দায়ভার গ্রহণ করতে আগ্রহী। জি২০-তে বৈশ্বিক কর্মসূচিকে আকার দিতে এটি কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করবে অন্য দেশগুলি বর্তমান সময়ের সঙ্কটকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে, তার উপর। তার দিক থেকে নয়াদিল্লি চেষ্টার কোনও খামতি রাখছে না এবং তার লক্ষ্য গগনচুম্বী।